ছেমা ই দালালাত
ছেমা আরবী শব্দ, যার আভিধানিক অর্থ,শোনা বা শ্রবণ করা।আল্লাহপাক সুরানাহল ১২৫ নং আয়াতে এরশাদ করেন, খোদারদিকে জনগণকে হেকমত, কৌশল ও সৎকার্যের উৎসাহপূর্ণ কথা দ্বারা আহবান কর।সুতরাং উক্তআয়াতে হেকমত শব্দ দ্বারাসূফীগণ গান বাদ্যের সুন্দর সুরদ্বারা মানুষকে আল্লাহর পথে আহবান করা কে বুঝিয়েছেন।প্রথমেই আমাদের ধারণায় আনতে হবে আল্লাহ কোর’আনে কোথাও গান-বাজনা হারাম করেন নি। যা কিছু হারাম তা মহান আল্লাহ স্পষ্ট করে বলেই দিয়েছেন। পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ বলেন, “তোমাদের জন্য যা হারাম করা হয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে (সুরা আল আনআম ১১৯)।” আল্লাহ পবিত্র কোর’আনের কোথাও গান-বাজনার ব্যাপারে কোন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন নি।রসুলাল্লাহ (স.) এর জীবন থেকে যদি আমরা দেখি তবে স্পষ্ট দেখবো তিনি সুস্থ বিনোদন, আনন্দ উৎসব ও গান-বাজনা ইত্যাদি বর্জন করেন নি। তাঁর নবী হওয়ার পর থেকে সমগ্র জীবনটাই কেটেছে সংগ্রামে আর যুদ্ধে, হাজারো ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে। মাত্র ২৩ বছরে তাঁকে ৭৮ টি যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করতে হয়েছে যেখানে অনেকগুলোতেই তিনি নিজে প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব প্রদান করেছেন। এমন একজন বিপ্লবীর পক্ষে সারাদিন ঘরে বসে থেকে গান শোনা সম্ভব হয় নি, তবুও তিনি চিত্তবিনোদনের জন্য গান শুনেছেন।
হাদিসে রয়েছে, “রসুল (স.) একদিন মদিনার গলিপথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। কয়েকটি বালিকা দফ বাজিয়ে গান গেয়ে বলছিলো, আমরা বনু নাজ্জারের বালিকার দল, কত খোশনসীব! মুহাম্মদ (স.) আমাদের প্রতিবেশী। তখন আল্লাহর রসুল বলেন, আল্লাহ অবগত আছেন, আমি তো তোমাদের ভালোবাসি (সুনানে ইবনে মাজাহ)।” অন্যত্র দেখা যায়, আবু বোরায়দা (রা.) থেকে বর্ণিত, “একদিন রসুলাল্লাহ যুদ্ধ থেকে ফিরার পর একজন কালো বর্ণের তরুণী তাঁর কাছে হাজির হলেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রসুল, আমি মানত করেছিলাম যে আল্লাহ যদি আপনাকে সহিহ সালামত যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরিয়ে আনেন তবে আমি আপনার সামনে দফ বাজাবো ও গান গাইবো। আল্লাহর রসুল জবাব দিলেন, তুমি যদি মানত করে থাকো তবে তা পূর্ণ করো। অতঃপর তরুণীটি গান গাইতে শুরু করলো। এই সময় আবু বকর (রা.) প্রবেশ করলেন তবুও সে বাজাতে থাকলো, হযরত আলী (রা.) প্রবেশ করলেন তবুও সে থামলো না, হযরত উসমান (রা.) প্রবেশ করলেন এবং তখনও সে বাজাচ্ছিল। কিন্তু যখনই উমর (রা.) উপস্থিত হলেন তরুণীটি তার দফ নামিয়ে রাখলো। আল্লাহর রসুল তখন বললেন, হে উমর! শয়তানও তোমাকে ভয় পায়। আমি বসে ছিলাম আর এই তরুণীটি দফ বাজিয়ে গান করছিলো, আবু বকর, আলী যখন প্রবেশ করে তখনও সে বাজাচ্ছিলো, উসমান আসার পরই সে থামেনি কিন্তু যখনই তুমি আসলে সে দফটি রেখে দিল (তিরমিযি শরীফ, দ্বিতীয় খণ্ড)। মুসলমানদের জানমালের হেফাযতে রাসূল বিল্লালকে সুসংবাদ দেওয়ার জন্য অনুমতি দিলে, বিল্লাল গলায় ঢোল নিয়ে তা প্রচার করেছিলো! সাক্ষী তার (বুখারী শরীফ) ৩য় খন্ড ১৯ পৃষ্ঠা!!
২- হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্নিত, তিনি বলেনঃ একবার রাসূল(সাঃ) আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে রেখেছিলেন আর আমি মসজিদে সামনে হাবশীদের খেলা দেখছিলাম। হযরত ওমর এসে আমাকে শাসালে রাসূলুল্লাহ(সা) বল্লেনঃ সে বণি আরকাদা! তোমরা নির্বিঘ্নে খেলা দেখাও। (বুখারী)
৩- বুখারী শরীফে একটি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়, তা হল- একবার এক মহিলা রাসূল(সা) এর কাছে এসে শপথ করে বলল, ” হে রাসূল! আপনি যদি যুদ্ধ থেকে বিজয়ী বেশে ফিরে আসেন তবে আমি একটি গান গাইব।” রাসূল(সাঃ) কিন্তু ঐ মহিলাটিকে এই কথা বলে মন ভেঙ্গে দেননি যে, না…তুমি এটা করতে পারনা। গান গাওয়া হারাম। বরং রাসূল(সা) যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে মহিলাটিকে তার শপথ পূরণ করার সুযোগ দেন কেননা ইসলাম পূর্বযুগে মহিলাদের কোন শপথ পূরণের সুযোগ দেওয়া হতনা। মহিলাটি খুবই সাধারণ ভাবে একটি গানের কিছু অংশ গাইল।
৪- বুখারীতে আরো একটি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় যে, রাসূল(সা) যখন মদীনায় প্রবেশ করেন তখন সবাই দ্বফ ও ড্রাম জাতীয় বাদ্য বাজিয়ে গান গাইছিল যে, “তালা’আল বাদরু আলাইনা…………”। তখন আবু বকর(রা) তাদেরকে নিষেধ করতে চাইলে রাসূল(সা) বললেন, না…ইয়াহুদীদের জানতে দাও যে আমাদের ধর্মেও আরাম ও বিনোদনের স্থান রয়েছে।
গান ও বাদ্যের ব্যপারে কুশায়রী, কুরতুবী এবং ইমাম গাজ্জালী বলেনঃ
আল কুরতুবী তার আল আহকাম আল কুরআন গ্রন্থে কুশায়রীর বক্তব্য তুলে ধরেছেন যার সরাসরি ইংরেজী অনুবাদটি হলঃ ” Musical instruments were played in front of the Prophet(PBUH) to welcome him during his first arrival in Madina and Abu Bakr(Ra) wanted to scold and reprimand those who were playing the instruments but the Prophet(PBUH) stopped him saying: ‘Leave them alone o Abu Bakr so that the Jews will also learn and know that our religion is relaxed and accommodating’. ”
এরপর কুরতুবি (রহঃ) বলেনঃ It has been said that the ruling, regarding the use of drums in wedding celebrations is the same as the use of tambourine(Daff). It is permissible to use them as long as the lyrics or verses of the song are not offensive or profane. (Ahkam Al Quran of ibn Arabi, Vol:3, P:1494)
সেমা/সংগীত এর দলিলঃ
যে গান কু-প্রবৃত্তি জাগায় সে গান নাজায়েজ,
যে গান আল্লাহর কথা মনে করিয়ে দেয়, ভাল কাজের প্রেরনা জোগায় সে গান জায়েজ।
সেমা/সংগীতের প্রশংসা ও সমর্থনসূচক চল্লিশটি হাদিস মৌজুদ আছে। নিচে কিছু সহীহ
হাদিস শরীফের রেফেরেন্স
দেওয়া হলঃ
(১) বোখারী শরীফ ১ম খণ্ড ১৩৫ পৃঃ,
(২) নেসায়ী শরীফ ১ম খণ্ড ১৮১ পৃঃ,
(৩) মুসলিম শরীফ ১ম খণ্ড ২৯১ পৃঃ,
(৪)বোখারী শরীফ ১ম খণ্ড ১৩০ পৃঃ, (৫)
মেশকাত শরীফ ২৭৩ পৃঃ,
(৬)তিরমিজী শরীফ ১ম খণ্ড ২০৭ পৃঃ,
(৮)মেশকাত শরীফ ৫৫৮ পৃঃ,
(৯)মেশকাত শরীফ ২৭২ পৃঃ,
(১০) নেছায়ে ২য় খণ্ড ৭৫ পৃঃ,
(১১)বোখারী শরীফ ২য় খণ্ড ৭৭৩ পৃঃ, (১২), মেশকাত শরীফ ২৭১ পৃঃ,
(১৩) মুসলিম শরীফ ১ম খণ্ড ২৯২ পৃঃ,
(১৪)বোখারী শরীফ ২য় খণ্ড ৭৭৫ পৃঃ,
(১৫) তাফসীরে আহমদি-৪০০ পৃঃ,
(১৬) ইবনে মাজা-১৩৮
(১৭)বোখারী শরীফ ২য় খণ্ড ৭৫৫ পৃঃ, (১৮)
"ওয়ালাকাদ আতাইনা দাউদা মিন্না ফাদলা ।"
অর্থাৎঃ "আমি দাউদকে প্রাধান্য প্রদান করিয়াছিলাম আর এই প্রাধান্য ছিল তাহার সুললিত মধুর সুর ও সঙ্গীত বিদ্যা ।"
>(সূরা সাবা:১০)
হাদিসঃ
১। আবু মুসা রাসুল পাক (স.) এর একজন সাহাবী ছিলেন। তিনি সুমধুর সুরে গান করিতে পারিতেন এবং রাসুলপাক (স) কে সময়
সময় গান শুনাইতেন।তাই তার গানের সুরের প্রশংসা করে নবী পাক (স) বলেন,
"হে আবু মুসা ,নিশ্চয়ই দাউদের বংশধরের সঙ্গীত হইতে তোমাকে সঙ্গীত প্রদান করা হইয়াছে ।" ( বুখারী শরীফঃ ৭৫৫)
২। হযরত আয়েশা (র) হইতে বর্ণিত যে, আমি একটি স্ত্রীলোকের বিবাহ আনসারের একটি লোকের সাথে করিয়া দিলাম। তখন রাসুল
পাক (স) ফরমাইলেন " তোমাদের নিকট কি কোন
গানের বন্দোবস্ত নাই??? কারন আনসারগন গান ভালোবাসেন। (বুখারী -রাবি আশায়াতুল লোমায়াত শরহে মিশকাত ,৩য় খণ্ড -সোহবত অধ্যায়ের ১০৮ পৃষ্ঠা )
তাফসীরে আহমদি-৪০১ পৃঃ,
বর্তমানকালের একজন শীর্ষস্থানীয় আলেম ড. ইউসুফ আল-কারযাভী এ বিষয়ে একটি বই লিখেছেন। বইটির বিশেষত্ব হলো এর পক্ষে-বিপক্ষে প্রচলিত মতামতগুলো তিনি বিশ্লেষণসহ তুলে ধরেছেন। তারপর নিজের মতামত উল্লেখ করেছেন। সেদিক থেকে বইটি বেশ সমৃদ্ধ। এটি ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করেছেন শাইখুল আবরার।
গান, বিশেষ করে বাদ্যযন্ত্রসহ গানকে যারা হারাম সাব্যস্ত করেন তারা এর পক্ষে কিছু দলীল-প্রমাণ উপস্থাপন করেন। তবে যারা গানকে হালাল মনে করেন, তারা অবশ্য এসব দলীল-প্রমাণকে খণ্ডন করে থাকেন। নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকে তারা তাদের মতামতের পক্ষে দলীল হিসেবে তুলে ধরেন–
- কোরআনের আয়াত।
- মারফু ও মাওকুফ হাদীস।
- গান, বিশেষ করে বাদ্যযন্ত্রসহ গান হারাম হওয়ার ব্যাপারে ইজমা (আলেমদের মতৈক্য) রয়েছে বলে দাবি করা।
- সাদ্দ আয-যারাই (سد الذرائع)[1] তথা হারাম কাজ করার অজুহাত বন্ধের মূলনীতি।
- সন্দেহজনক কাজ থেকে বেঁচে থাকা ও সাবধানতা অবলম্বন সংক্রান্ত মূলনীতি।
আমরা তাদের উপস্থাপিত প্রত্যেকটি প্রমাণ উল্লেখ করে একে একে তা খণ্ডন করে যুক্তি তুলে ধরবো।
১। কোরআন থেকে উপস্থাপিত দলীল ও এর ব্যাখ্যা
যারা গান শোনাকে নিষিদ্ধ মনে করেন এবং একে হারাম সাব্যস্ত করেন তারা বেশ কিছু কোরআনের আয়াতকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন। আমরা প্রথমে সেই আয়াতগুলো এখানে তুলে ধরবো। তারপর সেগুলো গানকে আদৌ হারাম প্রতিপন্ন করে কিনা, সে ব্যাপারে পর্যালোচনা করবো।
ক) লাহওয়াল হাদীস (অর্থহীন কথাবার্তা) সংক্রান্ত কোরআনের আয়াত:
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
وَمِنَ النَّاسِ مَن يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَن سَبِيلِ اللَّـهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا ۚ أُولَـٰئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُّهِينٌ
“মানুষদের মাঝে এমন ব্যক্তিও আছে যে লাহওয়াল হাদীস খরিদ করে, যাতে করে সে (এ দিয়ে মানুষদের) অজ্ঞতার ভিত্তিতে মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে। সে একে হাসি-বিদ্রুপ-তামাশা হিসেবেই গ্রহণ করে; এদের জন্যে অপমানজনক শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।” (সূরা লোকমান: ৬)
ইবনে মাসউদ (রা), ইবনে আব্বাস (রা) ও ইবনে ওমর (রা) থেকে বিশুদ্ধভাবে বর্ণিত আছে: উল্লেখিত আয়াতে ‘লাহওয়াল হাদীস’ বলতে গানকে বোঝানো হয়েছে। ইবনে মাসউদ (রা) তো রীতিমতো শপথ করেই বলেছেন: আল্লাহর শপথ! ‘লাহওয়াল হাদীস’ বলতে গানকেই বোঝানো হয়েছে![2] ইবনুল কায়্যিমসহ অনেকেই এটি উল্লেখ করেছেন। এছাড়া ‘আল-মুসতাদরাক’ গ্রন্থের তাফসীর অধ্যায়ে ইমাম হাকীম বলেছেন: তাফসীর শাস্ত্রের ছাত্ররা যেন এটা জেনে রাখে– শায়খাইনের (হাদীস শাস্ত্রে ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমকে একত্রে শায়খাইন বলা হয়) মতে সাহাবীদের করা পবিত্র কোরআনের তাফসীর মুসনাদ হাদীসের[3] অন্তর্ভুক্ত।
ইমাম হাকীম তাঁর বইয়ের অন্যত্র বলেছেন: সাহাবীগণ কোরআনের যেসব তাফসীর করেছেন, আমাদের মত অনুযায়ী সেগুলো মারফু হাদীসের[4] ক্যাটাগরিতে পড়বে।
ইবনুল কায়্যিম বলেছেন: যদিও এখানে কথা থাকে, তারপরও এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, সাহাবীদের করা কোরআনের তাফসীর সাহাবীদের পরবর্তীকালে অন্যদের রচিত তাফসীরের চেয়ে অধিক গ্রহণযোগ্য।[5]
ইমাম আল-ওয়াহেদী উল্লেখ করেছেন: অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে লাহওয়াল হাদীস দ্বারা গান বুঝানো হয়েছে। এটি মূলত বিশিষ্ট মুফাসসির মুজাহিদ ও ইকরিমার দাবি।[6]
এ ব্যাপারে আমাদের অবস্থান:
এই পদ্ধতিতে দলীল উপস্থাপনের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে আসার ক্ষেত্রে আমাদের রয়েছে স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি।
প্রথমত: এই আয়াতের এটিই একমাত্র তাফসীর নয়। মুফাসসিরদের অনেকে আয়াতটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, লাহওয়াল হাদীস বলতে রোম সাম্রাজ্যসহ বিভিন্ন অনারব রাজ্যের রাজা-বাদশাহদের নিয়ে সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের কিচ্ছা, গালগপ্পো ও গুজবকে বুঝানো হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে নাদার বিন হারিসের কথা বলা যায়। কোরাইশদের মধ্যে এই লোকটি ছিলো একজন কট্টর মুশরিক। এই লোক মক্কাবাসীদের এইসব গুজব ও গালগপ্পো বলে বেড়াতো, যাতে করে তাদেরকে কোরআন থেকে বিমুখ রাখা যায়। মজার বিষয় হলো, এই বিষয়টি ইবনুল কায়্যিম নিজেও উল্লেখ করেছেন।
দ্বিতীয়ত: সাহাবীদের তাফসীরের পক্ষে কোনো সাবাব আন-নুযূল[7] বা এ জাতীয় নির্ভরযোগ্য কিছু পাওয়া না গেলে, সেই তাফসীরকে আমরা মারফু হাদীসের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করি না। কোরআনকে সাহাবীগণ যেভাবে বুঝেছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের তাফসীরগুলো সেই বুঝজ্ঞানের বেশি কিছু নয়। এ জন্য দেখা যায়, কখনো কখনো একজন সাহাবীর তাফসীর আরেকজন সাহাবীর তাফসীরের বিপরীত। যদি তাঁদের সকল ব্যাখ্যাই মারফু হাদীসের অন্তর্ভুক্ত হতো, তাহলে তাঁদের তাফসীরে এ ধরনের মতদ্বৈততা থাকতো না।
তৃতীয়ত: আয়াতটির এই তাফসীরের যথার্থতা ও এটি মারফু হাদীসের শ্রেণীভুক্ত হওয়ার দাবিকে আমরা যদি মেনেও নেই এবং তাফসীরটি যদি প্রকৃতপক্ষে মারফু হাদীসভুক্ত হয়েও থাকে, তাহলেও আমাদের আলোচ্য বিষয়ে এই আয়াতটি দলীল হিসেবে টিকে না। কারণ, এতে নিছক গান কিংবা লাহওয়াল হাদীসে মগ্ন হওয়াকে নিন্দা করা হয়নি। বরং যে ব্যক্তি আল্লাহর পথের ব্যাপারে মানুষকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে লাহওয়াল হাদীস ক্রয় করে এবং এ ব্যাপারটিকে ঠাট্টা-মশকরা হিসেবে বিবেচনা করে, তার ব্যাপারেই ভর্ৎসনা ও অপমানজনক শাস্তির কথা হয়েছে। তাই এই আয়াতটি আমাদের আলোচ্য বিষয়ে প্রাসঙ্গিক নয়।
ইবনে হাজমের মতামত:
ইবনে মাসউদ ও অন্যান্যদের কথা টেনে যারা দলীল পেশ করেন তাদের জবাবে আবু মুহাম্মাদ ইবনে হাজম যে কথাগুলো বলেছেন, সেগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন: “এই প্রসঙ্গে ইবনে মাসউদ (রা) ও অন্যান্যদের তাফসীর কয়েকটি কারণে দলীল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে না।
প্রথমত: আল্লাহর রাসূল (সা) ছাড়া আর কারো কথাই চূড়ান্ত যুক্তি বা দলীল হতে পারে না।
দ্বিতীয়ত: তাঁদের মতামত অন্যান্য সাহাবী ও তাবেয়ীগণের মতামত থেকে ভিন্ন।
তৃতীয়ত: তাঁরা যে আয়াতটিকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন, সেটি স্বয়ং তাঁদের যুক্তিকে খণ্ডন করে। কারণ আয়াতে বলা হয়েছে: “মানুষদের মাঝে এমন ব্যক্তিও আছে যে লাহওয়াল হাদীস খরিদ করে, যাতে করে সে অজ্ঞতার ভিত্তিতে মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে। সে একে হাসি-বিদ্রুপ-তামাশা হিসেবেই গ্রহণ করে; এদের জন্যে অপমানজনক শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।” (সূরা লোকমান: ৬)। এটি এমন একটা কাজ যা কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে করলে কাফের হয়ে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
এমনকি কোনো ব্যক্তি যদি মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে সরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে কোরআনের একটি কপিও ক্রয় করে এবং ব্যাপারটিকে তামাশা হিসেবে বিবেচনা করে, তাহলে নিঃসন্দেহে সে কাফের হয়ে যাবে। মূলত এই বিষয়টিকেই আল্লাহ ভর্ৎসনা করেছেন। এই উদ্দেশ্যের বাইরে স্রেফ অবকাশ ও বিনোদন হিসেবে লাহওয়াল হাদীস ক্রয়কারী ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতে মোটেও ভর্ৎসনা করেননি। অন্যদিকে, ইচ্ছাকৃতভাবে নামাজ ত্যাগকারী ব্যক্তি যদি গান, আড্ডাবাজি, এমনকি কোরআন তেলাওয়াত, হাদীস পাঠ ইত্যাদিও করে, তাহলে সেই ব্যক্তি নিশ্চিত ফাসেক। আবার, কেউ বিনোদনমূলক বিষয়গুলোতে জড়িত থাকলেও কোনো ফরজ বিধান লংঘন না করলে সেই ব্যক্তি নিশ্চয় মুহসিন।”[8]
ইবনে হাজমকে ইমাম গাজ্জালীর সমর্থন:
ইমাম ইবনে হাজমের বক্তব্যের উপর ইমাম আবু হামীদ আল গাজ্জালী বেশ গুরুত্ব দিয়েছেন। আলোচ্য আয়াত দিয়ে যারা গানকে হারাম সাব্যস্ত করতে চান,তাদের জবাবে ইমাম গাজ্জালী বলেছেন:
“দ্বীনের পরিবর্তে লাহওয়াল হাদীসকে প্রতিষ্ঠা করা অর্থাৎ, আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে লাহওয়াল হাদীস ক্রয় করা নিশ্চয় অত্যন্ত নিন্দনীয় ও হারাম কাজ। এতে দ্বিমত পোষণের কোনো সুযোগ নেই। তবে সব গান এমন নয়, যেমনটা আলোচ্য আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।
আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করানোর উদ্দেশ্যে কেউ যদি কোরআন তেলাওয়াতও করে, তাহলে সেটিও হারাম হবে। মুনাফিকদের একটি ঘটনা এই মতকে শক্তিশালী করে। এক মুনাফিক নামাজের ইমামতি করতো। সূরা আবাসা ছাড়া অন্য কোনো সূরা সে নামাজে তেলাওয়াত করতো না। সূরাটিতে যেহেতু আল্লাহর তরফ থেকে রাসূলকে (সা) একটু কড়া কথা বলা হয়েছে, তাই সে ইচ্ছাকৃতভাবেই এই কাজ করতো। মানুষকে বিভ্রান্ত করা যেহেতু লোকটির উদ্দেশ্য ছিলো, তাই ওমর (রা) লোকটির এহেন কাজকে হারাম সাব্যস্ত করেন। ফলে গান বা কবিতা দিয়ে কেউ যদি মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চায়, তবে তা নিশ্চয় হারাম হওয়ার দাবি রাখে।”[9]
আয়াতে বর্ণিত ‘কঠিন শাস্তি’ বলতে আসলে যা বোঝায়:
এ প্রসংগে ইবনে হাজম এবং ইমাম গাজ্জালীর মতামত বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের মতে, নিছক বিনোদন বা খেল-তামাশায় লিপ্ত হলে কঠিন শাস্তি প্রদান করা হবে, এমনটা এই আয়াতে বুঝানো হয়নি। প্রকৃতপক্ষে আলোচ্য আয়াতের পরবর্তী আয়াতটি বিবেচনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পরের আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
وَإِذَا تُتْلَىٰ عَلَيْهِ آيَاتُنَا وَلَّىٰ مُسْتَكْبِرًا كَأَن لَّمْ يَسْمَعْهَا كَأَنَّ فِي أُذُنَيْهِ وَقْرًا ۖ فَبَشِّرْهُ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ
“যখন তার সামনে আমার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করা হয় তখন সে দম্ভ ভরে মুখ ফিরিয়ে নেয়, যেন সে কিছুই শুনতে পায়নি, যেন সে বধির। তাকে তুমি কঠোর আযাবের সুসংবাদ দাও।” (সূরা লোকমান:৭)
একজন মুসলিম কখনই আয়াতে উল্লেখিত ব্যক্তিটির মতো বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হতে পারে না। কারণ, মুসলমান মাত্রই বিশ্বাস করে– কোরআন নিশ্চয়ই আল্লাহর কালাম। কোনোভাবেই এর ভেতর মিথ্যা প্রবেশ করতে পারে না। কারণ এটি এমন এক গ্রন্থ, যা মহা প্রজ্ঞাময় ও সমস্ত প্রশংসার আধার আল্লাহর তরফ থেকে অবতীর্ণ।
আর তাই আমরা দেখি, ইমাম ইবনুল কায়্যিমের মতো ব্যক্তিও (গান হারাম হওয়ার পক্ষে যিনি ছিলেন অত্যন্ত সোচ্চার) স্বীকার করেছেন– আলোচ্য আয়াতগুলোতে বর্ণিত কঠিন শাস্তি মূলত এমন লোকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যে ব্যক্তি কোনো বিচার-বিবেচনা ছাড়াই স্রেফ ঠাট্টাচ্ছলে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার উদ্দেশ্যে কোরআনের স্থলে লাহওয়াল হাদীসকে প্রতিস্থাপন করে। তার সামনে কোরআন তেলাওয়াত করা হলে অহংকারবশত মুখ ফিরিয়ে নেয়, যেন সে বধির, কিছুই শুনতে পায়নি! যখন কোরআন থেকে কিছু জানার সুযোগ তার হয়, তখন সে তা নিয়ে মশকরা শুরু করে। খুব বড় মাপের কাফেরের মধ্যেই কেবল এই সকল বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে।[10]
এ পর্যায়ে এসে আমরা দেখি, প্রায়োগিক দিক থেকে ‘কঠিন শাস্তি’ সংক্রান্ত আয়াত দুটো বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এ ধরনের লোকেরা কোরআন বুঝা ও মেনে চলতে আগ্রহীদেরকে খেল-তামাশা বা বিনোদনের নামে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়।
ইবনে ওয়াহাবের বরাত দিয়ে ইমাম ইবনে জারীর আত-তাবারী তাঁর তাফসীর গ্রন্থে এ সম্পর্কে যে উদ্ধৃতি দিয়েছেন, তা এই বক্তব্যকে সমর্থন করে। ইবনে ওয়াহাব উল্লেখ করেছেন, ‘মানুষদের মাঝে এমন ব্যক্তিও আছে যে লাহওয়াল হাদীস খরিদ করে…’ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে জায়েদ বলেছেন: আয়াতে নির্দেশিত ব্যক্তিরা হলো মূলত কাফেরের দল। তোমরা কি এই আয়াত দেখোনি, যেখানে আল্লাহ বলেছেন– ‘যখন তার সামনে আমার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করা হয় তখন সে দম্ভ ভরে মুখ ফিরিয়ে নেয়, যেন সে কিছুই শুনতে পায়নি, যেন সে বধির।’ এ বৈশিষ্ট্য যাদের মধ্যে বিদ্যমান, তারা আদৌ মুসলিম হতে পারে না।
তিনি আরো বলেছেন: লোকেরা বলে, এই আয়াত নাকি তোমাদের, মানে মুসলমানদের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু আসলে তা নয়। তিনি আরো বলেছেন: ‘লাহওয়াল হাদীস’ মানে গালগপ্পো ও অর্থহীন কথাবার্তা।[11]
ইমাম ইবনে আতিয়্যাহ বলেছেন: সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মত হলো, আয়াতটিতে ‘লাহওয়াল হাদীস’ দিয়ে কুফরকেই উদ্দেশ্য করা হয়েছে। যেহেতু “যাতে করে সে (এ দিয়ে মানুষদের) অজ্ঞতার ভিত্তিতে মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে। সে একে হাসি-বিদ্রুপ-তামাশা হিসেবেই গ্রহণ করে…” মর্মে আয়াতটির শেষে কঠিনঅপমানজনক শাস্তির হুমকি দেয়া হয়েছে।[12]
ইমাম ফখরুদ্দীন রাযীও তাঁর তাফসীরে উপরের মতটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তবে তাঁর ব্যাখ্যাটি বেশ অভিনব। তিনি ছাড়া আর কেউ এমনটা উল্লেখ করেননি। ইমাম রাযী ‘মানুষদের মাঝে এমন ব্যক্তিও আছে যে লাহওয়াল হাদীস খরিদ করে…’ আয়াতটির তাফসীর করতে গিয়ে বলেছেন, “আল-কোরআন হলো প্রজ্ঞাময় আয়াত সম্বলিত কিতাব। অথচ কাফেররা একে অগ্রাহ্য করে অন্য কিছুতে মগ্ন হয়ে পড়তো। বেশ কিছু কারণে তাদের এই আচরণকে মন্দ হিসেবে সাব্যস্ত করা যায়–
প্রথমত, স্বভাবতই প্রজ্ঞাকে উপেক্ষা করে অন্য কোনো আলোচনায় নিমগ্ন হওয়াটা একটা বাজে কাজ।
দ্বিতীয়ত, মগ্ন হওয়া আলোচনার বিষয়টিও যদি বাজে ও নিরর্থক হয়, তাহলে সেটি আরো বেশি খারাপ কাজ।
তৃতীয়ত, কখনো কখনো আনন্দ-তামাশার বিষয়গুলো স্রেফ চিত্তবিনোদনের জন্য হয়ে থাকে। যেমনটা ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত আছে। তিনি বলেছেন, তোমরা আনন্দ-বিনোদন করো। আর রাসূল (সা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, “তোমরা ক্বলবকে মাঝেমধ্যে বিনোদিত হবার সুযোগ দিও।” হাদীসটি দায়লামী আনাস থেকে মারফু হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাছাড়া সহীহ মুসলিমে এর সমর্থনে আরেকটা হাদীস বর্ণিত হয়েছে। রাসূল (সা) বলেছেন, “ও হানযালা! সব কিছুর জন্য নির্ধারিত সময় আছে।” এসব হাদীস থেকে সাধারণ মানুষজন মনে করে, এখানে লাগামহীন হাসি-তামাশা বা রসিকতার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু আলেমদের মত হলো– এখানে যথাযথভাবে ইবাদত ও সংশ্লিষ্ট করণীয়গুলো পালন করার সাপেক্ষে বিনোদনকে উৎসাহিত করা হয়েছে। অন্যথায় নয়। আর যখন এই বিনোদনের উদ্দেশ্য হয় অন্যকে পথভ্রষ্ট করা, তখন এ ধরনের কাজ নিঃসন্দেহে গর্হিত ও অন্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। আল্লাহ তায়ালা ‘মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে’ মর্মে আয়াতটিতে যেমনটা উল্লেখ করেছেন।
তারপর আল্লাহ তায়ালা ‘بغير علم’ দিয়ে সেসব লাহওয়াল হাদীস বেচাকেনাকে উদ্দেশ্য করেছেন, যা তারা কাণ্ডজ্ঞানহীনভাবে ক্রয় করে থাকে এবং ‘ويتخذها’ মানে হলো আল্লাহর পথকে তারা গ্রহণ করে ঠাট্টা-মশকরা হিসেবে। তাই তাদের জন্য অপমানজক শাস্তি বরাদ্দ করা হয়েছে। ‘مهين’ তথা অপমানজক শাস্তি বলতে আল্লাহ তায়ালা শাস্তির স্থায়িত্বকে ইঙ্গিত করেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এক রাজা তার কর্মচারীদের মধ্য থেকে একজনকে শাস্তির আদেশ দিলো। কিন্তু দণ্ড কার্যকরের জন্য নিয়োজিত রাজকীয় সৈনিক যদি বুঝতে পারে, কর্মচারীটি বাদশাহর বশ্যতা পুনরায় মেনে নেবে, তাহলে জেলের মধ্যে তাকে কিছুটা সম্মান করবে, শাস্তিও তুলনামূলকভাবে কম দেবে। আর যদি মনে হয়, কর্মচারীটির মধ্যে রাজার বশ্যতা মেনে নেয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, সেক্ষেত্রে তাকে অপমানজনক শাস্তি মুখোমুখি হতে হয়। ‘عذاب مهين’ দিয়ে মূলত এই ধরনের অপমানজনক শাস্তির কথা বোঝানো হয়েছে। এ থেকে মুমিন ও কাফেরের শাস্তির পার্থক্য সম্পর্কে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। মুমিনকে শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্য মূলত তাকে সংশোধন করা, অপমান করা নয়।”
তারপর “যখন তার সামনে আমার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করা হয় তখন সে দম্ভ ভরে মুখ ফিরিয়ে নেয়, যেন সে কিছুই শুনতে পায়নি, যেন সে বধির। তাকে তুমি কঠোর আযাবের সুসংবাদ দাও।” আয়াতটির ব্যাখ্যায় ইমাম রাযী বলেন,
“এর মানে হলো অর্থহীন কথাবার্তা সে মূল্য দিয়ে ক্রয় করে। আর অর্থপূর্ণ সত্য বিনামূল্যে সামনে আসলেও মুখ ফিরিয়ে নেয়। আয়াতটি সুক্ষ্মভাবে খেয়াল করলে দেখবেন, এর মধ্যে একটা অসাধারণত্ব আছে। সচরাচর কোনো ক্রেতা যখন কিছু কিনতে চান, তখন সেই পণ্যের জন্য তার কাছ থেকে দাম চাওয়া হয়। তবে ক্রেতা কিনতে চাননি এমন কিছু ফ্রি দেয়া হলে সেটি তিনি সানন্দেই গ্রহণ করে থাকেন। একইভাবে বুদ্ধিমান ব্যক্তির উচিত যে কোনো কিছুর বিনিময়ে হলেও হিকমাহ তথা প্রজ্ঞা ক্রয় করা। কিন্তু প্রজ্ঞাময় কোরআনের আয়াত না চাইতেও যখন তাদের কাছে আসলো, তখনও মুখ ফিরিয়ে নেয়া দাম্ভিক লোকগুলো তা শুনতে চাইতো না। এখানেও আবার কয়েকটা পর্যায় রয়েছে–
প্রথমত, হিকমাহ (প্রজ্ঞা) পরিহার করা। এটি নিঃসন্দেহে একটি মন্দ কাজ।
দ্বিতীয়ত, অহংকার প্রদর্শন করা। কারণ, যে ব্যক্তি রুস্তম-বাহরামের কাহিনীর মতো ফালতু বিষয়ে মগ্ন থাকে, সে স্বভাবতই অহংকারের কারণে প্রজ্ঞা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কেবল তখনই তার অহংকার করা মানায় যদি সে দাবি করতে পারে, কোরআনের আয়াতের মতো প্রজ্ঞাময় কিছু বলার সামর্থ্য তারও রয়েছে। অথচ বাস্তবে তার সেই সামর্থ্য নেই। এই অক্ষমতার কারণেই সে অর্থহীন সব কাহিনী ফেরি করে বেড়ায়।
তৃতীয়ত, আয়াতের ‘যেন সে কিছুই শুনতে পায়নি’ অংশটুকু দ্বারা সেই অহংকারী লোকটাকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে, যে আজেবাজে কাহিনী শুনতে অভ্যস্ত। লোকটি কোরআনের প্রজ্ঞাময় কথার দিকে ফিরে তাকায় না এবং এমন ভাব করে যেন তার কাছে এসবের কোনো পাত্তাই নেই।
চতুর্থত, ‘যেন সে বধির’ আয়াতাংশ দ্বারা মূলত ব্যক্তিটির স্পর্ধার মাত্রা বোঝানো হয়েছে। আর ‘তাকে তুমি কঠোর আযাবের সুসংবাদ দাও’ আয়াতের মানে হলো– এ ধরনের স্পর্ধা দেখানো ব্যক্তিটির জন্য রয়েছে অপমানজনক শাস্তি; অতএব, আপনি তাকে সতর্ক করুন এবং ভয় দেখান। কিংবা, হতে পারে এই আয়াত দিয়ে এটা বোঝানো হয়েছে, যার আচরণ উল্লেখিত করা ব্যক্তিটির মতো হবে, অতএব ‘তাকে তুমি কঠোর আযাবের সুসংবাদ দাও।”[13]
খ) অর্থহীন কথাবার্তা (লাগ্উ) এড়িয়ে চলা সংক্রান্ত আয়াত:
গানকে হারাম সাব্যস্তকারীদের আরেকটি দলীল হলো কোরআনের সেই আয়াত, যেখানে আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের প্রশংসা করে বলেছেন–
وَإِذَا سَمِعُوا اللَّغْوَ أَعْرَضُوا عَنْهُ
“আর যখন তারা অর্থহীন কথাবার্তা শুনে, তখন তারা সেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।” (সূরা কাসাস: ৫৫)
তাদের মতে, গানও অর্থহীন কথাবার্তার (লাগ্উ) অন্তর্ভুক্ত। তাই আয়াতের মর্মানুসারে গান শোনা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। অথচ আয়াতটির মূল অর্থের দিকে মনোযোগ দিলে বুঝা যায়, এখানে ‘আল-লাগ্উ’ শব্দটির মানে হলো– কাউকে মূর্খের মতো অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা, অপমান করা ইত্যাদি। আয়াতটির বাকি অংশে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَإِذَا سَمِعُوا اللَّغْوَ أَعْرَضُوا عَنْهُ وَقَالُوا لَنَا أَعْمَالُنَا وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ سَلَامٌ عَلَيْكُمْ لَا نَبْتَغِي الْجَاهِلِينَ
“আর যখন তারা অর্থহীন কথাবার্তা শুনে, তখন তারা সেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে আমাদের কাজের ফল আমাদের এবং তোমাদের কাজের ফল তোমাদের। তোমাদেরকে সালাম। আমরা জাহেলদের মতো পথ চলতে চাই না।” (সূরা কাসাস: ৫৫)
এই আয়াতের সাথে অন্য একটি আয়াতের বেশ মিল রয়েছে। সেখানে আল্লাহ তায়ালা ‘রহমানের বান্দাদের’ প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছেন:
وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلَامًا
“তাদের সাথে যখন মূর্খরা কথা বলতে আসে, তখন তারা বলে সালাম।” (সূরা ফুরকান: ৬৩)
এখন গানকেও যদি ‘লাগউ’ শব্দের অন্তর্ভুক্তু হিসেবে স্বীকার করা হয়, তাহলে আয়াতের ভাষ্য থেকে মূলত প্রতিপাদিত হয়: গান না শোনা মুস্তাহাব তথা উত্তম কাজ। অর্থাৎ, একে হারাম গণ্য করা হচ্ছে না।
‘লাগউ’ শব্দটি ‘বাতিল’ শব্দটির কাছাকাছি, যার অর্থ হলো: যে বিষয়ের মধ্যে কোনো ফায়দা বা উপকারিতা নেই। আর ফায়দাহীন গান শোনা ততক্ষণ পর্যন্ত হারাম হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তা কোনো অধিকার ক্ষুণ্ন করছে, বা কোনো কর্তব্য পালনে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
ইবনে জুরাইহ সম্পর্কে বর্ণিত আছে: তিনি গান শোনাকে বৈধ মনে করতেন। একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো: গান শোনা কেয়ামতের দিন আপনার ভালো কাজ হিসেবে গণ্য হবে, নাকি মন্দ কাজ হিসেবে গণ্য হবে? প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন: এটি ভালো-মন্দ কোনোটা হিসেবেই গণ্য হবে না। কারণ, গান শোনা ‘লাগ্উ’ তথা অনর্থক কাজের অন্তর্ভুক্ত। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন:
لَّا يُؤَاخِذُكُمُ اللَّـهُ بِاللَّغْوِ فِي أَيْمَانِكُمْ
“তোমাদের নিরর্থক (লাগ্উ) শপথের জন্য আল্লাহ তোমাদেরকে ধরবেন না।” (সূরা বাকারা: ২২৫)
ইমাম গাজ্জালী বলেছেন: চুক্তি বা সংকল্প করা হয়নি এমন কোনো বিষয়ে আল্লাহর নামে শপথ করা একটি নিরর্থক কাজ। বেহুদা হওয়া সত্ত্বেও এ ব্যাপারে কোনো জবাবদিহিতা বা শাস্তি নেই। তাহলে কাব্য ও নৃত্যের মতো নিরর্থক কাজের জন্য কীভাবে কাউকে অভিযুক্ত করা যায়?[14]
এই কথার জের ধরে আমরা আরো বলতে পারি: গান মাত্রই নিরর্থক নয়। গানের সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিয়ত ভেদে এ সংক্রান্ত বিধানের তারতম্য হতে পারে। সৎ নিয়তের কারণে মুবাহ, কিংবা অনর্থক কাজ ইবাদতের মানে উন্নীত হতে পারে। অন্যদিকে, অসৎ ও অশুদ্ধ নিয়ত এমন কাজকে ধ্বংস করে দেয়, যা বাইরে থেকে ইবাদতের মতো মনে হলেও ভিতরে লুকিয়ে থাকে রিয়া বা প্রদর্শনেচ্ছা। সহীহ হাদীসে এসেছে: “আল্লাহ তায়ালা তোমাদের বাহ্যিকতা বা ধন-সম্পত্তির দিকে মোটেও তাকান না। তিনি মূলত তোমাদের অন্তর ও কাজসমূহ দেখেন।”[15]
এ পর্যায়ে আমরা ইমাম ইবনে হাযমের একটি চমৎকার বক্তব্য উদ্ধৃত করতে পারি। এটি তিনি তাঁর ‘আল-মুহাল্লা’ নামক বিখ্যাত ফিকাহর কিতাবে উল্লেখ করেছেন। গান-বাজনার বিরোধিতা করে, এমন ব্যক্তিবর্গের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন: “(গানের বিরোধীরা) প্রমাণ হিসেবে বলে থাকেন বলেন: গান কি ‘আল-হক’ তথা সত্যের অন্তর্ভুক্ত? নাকি সত্য নয় এমন বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত? হকের অন্তর্ভুক্ত হওয়া বা না হওয়া – এই দুইয়ের বাইরে বিকল্প কোনো তৃতীয় পন্থা হতে পারে না। কারণ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: “সত্য আসার পর (আল্লাহকে না মানা) গোমরাহী ছাড়া আর কী?” (সূরা ইউনুস: ৩২)। এক্ষেত্রে আমাদের উত্তর হলো– রাসূল (সা) বলেছেন: ‘নিশ্চয়ই সমস্ত কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেক ব্যক্তি তা-ই পায়, যা সে নিয়ত করে।’[16] অতএব, যে ব্যক্তি আল্লাহর অবাধ্য হওয়ার নিয়তে গান শুনবে, সে নিঃসন্দেহে ফাসিক। গান ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রেও এই কথাটি সমপরিমাণে সত্য।
যে ব্যক্তি আরো ভালোভাবে আল্লাহর আনুগত্য করা ও ভালো কাজে নেমে পড়ার জন্য নিজেকে উজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে গান শুনবে, সে ব্যক্তি নিঃসন্দেহে আনুগত্যপরায়ণ ও ভালো মানুষ হিসেবে বিবেচিত হবে। আর যে ব্যক্তি গান শোনার ক্ষেত্রে আনুগত্য কিংবা পাপ কাজ কোনোটারই নিয়ত করে না, তার কাজটি ক্ষমাপ্রাপ্ত অর্থহীন কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে। এ ক্ষেত্রে গান শোনাও বাগানে ঘোরাফেরা করা; বাগানের গেটে বসে চারপাশের দৃশ্য অবলোকন করা; আকাশী, সবুজ বা অন্য কোনো রঙিন কাপড় পরিধান করা; পা ছড়িয়ে বা ভাঁজ করে আরাম করে বসে থাকার মতো সাধারণ একটি কাজ হিসেবে গণ্য হবে।”[17]
গ) অর্থহীন বিষয়কে ভদ্রতার সাথে পাশ কাটানো সংক্রান্ত আয়াত:
গানকে হারাম সাব্যস্তকারীগণ আরেকটা আয়াতকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করার চেষ্টা করেন। সেটি হলো:
وَالَّذِينَ لَا يَشْهَدُونَ الزُّورَ وَإِذَا مَرُّوا بِاللَّغْوِ مَرُّوا كِرَامًا
“আর যারা মিথ্যা কাজে যোগদান করে না এবং যখন অর্থহীন কাজকর্মের সম্মুখীন হয়, তখন মানসম্মান রক্ষার্থে ভদ্রভাবে সরে পড়ে।” (সূরা ফুরকান: ৭২)
সালাফদের কেউ কেউ ‘আয-যূর’ (মিথ্যা কাজ) শব্দটির তাফসীর করতে গিয়ে বলেছেন, এটি দিয়ে মূলত গান বোঝানো হচ্ছে। যেমন– মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়্যা বলেছেন: এই আয়াতে ‘আয-যূর’ শব্দটি দিয়ে গান ও নিরর্থক কাজকর্মকে বোঝানো হচ্ছে। হাসান, মুজাহিদ ও আবু জাহহাফ থেকে ঠিক একই ধরনের তাফসীর বর্ণিত আছে। আর গানকে ‘আয-যূর’ হিসেবে অভিহিত করায় এটি হারাম হিসেবে বিবেচিত হওয়াকেই প্রতিপাদন করে।
অন্যদিকে, আল-কালবী বলেছেন: মুমিনরা নিরর্থক বা ফালতু আসরে উপস্থিত হন না,[18] আর গান তো এসব নিরর্থক ও ফালতু আসরেরই অংশ।
উপরোক্ত এসব দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের কিছু কথা আছে:
প্রথমত: কোনো কোনো মুফাসসির আয়াতটির এমন ব্যাখ্যা করেছেন, যার সাথে গান বা তৎসংশ্লিষ্ট কোনো কিছুর দূরতম সম্পর্কও নেই। তারা আয়াতে উল্লেখিত ‘ইয়াশহাদুন’ (يشهدون) শব্দটির অর্থ করেছেন ‘শাহাদাহ’ (الشهادة) তথা সাক্ষ্য দেয়া হিসেবে; ‘শুহুদ’ (الشهود) তথা অবলোকন করা বা দেখা অর্থে নয়। এর ফলে আয়াতটির অর্থ দাঁড়ায়, “(রহমানের বান্দা তো তারাই) যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না।” যদিও আমি এই অর্থটিকে প্রাধান্য দেই না।
যেমন কাতাদাহ বলেছেন, আয়াতে উল্লেখিত ‘আয-যুর’ শব্দের মূল অর্থ হলো মিথ্যা। অন্যদিকে, দাহহাক বলেছেন, এখানে ‘আয-যুর’ শব্দের অর্থ হলো শিরক।
দ্বিতীয়ত: মুফাসসিরদের কেউ কেউ ‘আয-যুর’ শব্দটির ব্যাখ্যা করেছেন ‘মুশরিকদের আনন্দ-উৎসব’ হিসেবে। কারণ, এসব উৎসবে জাহেলিয়াত ও পৌত্তলিকতা থেকে শুরু করে নানান ধরনের ভ্রান্ত বিষয়ের প্রচলন ছিল। ইবনে আব্বাস থেকে আল-খাতীব এমনটাই বর্ণনা করেছেন।
এছাড়া এ ব্যাপারে ইকরিমার বক্তব্যটি এই মতের বেশ কাছাকাছি। আয়াতটির ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন: ‘আয-যূর’ শব্দটি দিয়ে জাহেলী যুগে প্রচলিত খেলাধূলাকে বুঝানো হয়েছে।[19]
এছাড়া কিছু কিছু বিদয়াতপন্থী ও বিকৃতিকারীরা ওলী-আউলিয়াদের কবর ঘিরে যেসব সীমালঙ্ঘনমূলক কার্যকলাপ করে থাকে, সেগুলোও এই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত হবে।
এ ব্যাপারে মূলনীতি হলো: কোনো দলীলে যদি শরীয়াহসম্মত একাধিক সঠিক অর্থের সম্ভাবনা থাকে, তাহলে এসব অর্থের মধ্য থেকে যে কোনো একটিকে অকাট্যভাবে একমাত্র সঠিক বিবেচনা করার সুযোগ নেই।[20]
তৃতীয়ত: তর্কের খাতিরে যদি ‘আয-যুর’ শব্দটির ব্যাখ্যা হিসেবে ‘গান’কে সঠিক বলে ধরেও নিই, তখনও কিছু কথা থাকে। সেক্ষেত্রে বলতে হবে, এর মাধ্যমে সে ধরনের গানকেই বুঝানো হচ্ছে, যেগুলো মানুষকে পাপাচারের দিকে নিয়ে যায়, আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে এবং যেগুলোতে খারাপ কাজের মিশ্রণ থাকে।
চতুর্থত: তাছাড়া আলোচ্য আয়াতে এমন কোনো উপাদান নেই, যা দিয়ে ওয়াজিব বা আবশ্যকতা আরোপ করা যায়। বরং আলোচ্য আয়াতটিতে কেবল উল্লেখিত কাজগুলো পালন করাকে রহমানের বান্দাদের গুণ হিসেবে প্রশংসা করা হয়েছে। অন্য আরেকটি আয়াতেও যেভাবে প্রশংসা করে বলা হয়েছে:
وَالَّذِينَ يَبِيتُونَ لِرَبِّهِمْ سُجَّدًا وَقِيَامًا
“(রহমানের বান্দা তো তারাই) যারা রাত্রি যাপন করে পালনকর্তার উদ্দেশ্যে সেজদাবনত হয়ে ও দণ্ডায়মান হয়ে।” (সূরা ফুরকান: ৬৪)
এটা তো সহজেই বোধগম্য যে, এখানে যা করতে বলা হয়েছে সেগুলো কোনো আবশ্যকীয় ফরজ ইবাদত নয়। বরং এগুলো পরিপূর্ণতাদানকারী মুস্তাহাব কাজ।
ঘ) শয়তানের আওয়াজ সংক্রান্ত আয়াত:
গানকে হারাম সাব্যস্তকারীদের চতুর্থ দলীল হলো কোরআনের সেই আয়াতসমূহ, যেখানে আল্লাহ তায়ালা অভিশপ্ত শয়তানকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন:
قَالَ اذْهَبْ فَمَن تَبِعَكَ مِنْهُمْ فَإِنَّ جَهَنَّمَ جَزَاؤُكُمْ جَزَاءً مَّوْفُورًا – وَاسْتَفْزِزْ مَنِ اسْتَطَعْتَ مِنْهُم بِصَوْتِكَ وَأَجْلِبْ عَلَيْهِم بِخَيْلِكَ وَرَجِلِكَ وَشَارِكْهُمْ فِي الْأَمْوَالِ وَالْأَوْلَادِ وَعِدْهُمْ ۚ وَمَا يَعِدُهُمُ الشَّيْطَانُ إِلَّا غُرُورًا
“আল্লাহ তায়ালা বললেন– যাও (দূর হও এখান থেকে), যারা তোমার আনুগত্য করবে, তোমাদের সবার শাস্তি হচ্ছে জাহান্নাম, আর (জাহান্নামের) শাস্তি (হবে) পুরোপুরি। এদের মধ্যে যাকে যাকে পারো, তুমি তোমার আওয়াজ দিয়ে গোমরাহ করে দাও, তোমার যাবতীয় অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে তাদের ওপর দিয়ে চড়াও হও, ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে তুমি তাদের সাথী হয়ে যাও এবং তাদের প্রতিশ্রুতি দিতে থাকো; আর শয়তান তাদের যে প্রতিশ্রুতি দেয় তা তো প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।” (সূরা বনী ইসরাঈল: ৬৩-৬৪)
কোনো কোনো মুফাসসির এখানে উল্লেখিত ‘শয়তানের আওয়াজ’ শব্দের তাফসীর করতে গিয়ে বলেছেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো গান। মুজাহিদ বলেছেন, শয়তানের আওয়াজ মানে হলো গান, বাঁশী ও বিনোদন। আর দাহ্হাক বলেছেন, শায়তানের আওয়াজ মানে হলো বাঁশির আওয়াজ।
উপরোক্ত তাফসিরই একমাত্র সঠিক ও ভুলত্রুটির উর্ধ্বে, ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। ফলে একে মেনে নেয়া বাধ্যতামূলকও নয়। যেহেতু অন্যান্য মুফাসসিরগণ এই তাফসীরের বিপরীত মত দিয়েছেন। যেমন– ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত: শয়তানের আওয়াজ মানে হলো আল্লাহর অবাধ্যতার দিকে আহ্বানকারী যে কোনো কিছু। আবার বলা হয়েছে, শয়তানের আওয়াজ মানে হলো শয়তানের কুমন্ত্রণা।[21]
আর একটু আগে উল্লেখিত মূলনীতি তো রয়েছেই– কোনো দলীলে যদি শরীয়াহসম্মত একাধিক সঠিক অর্থের সম্ভাবনা থাকে, তাহলে এসব অর্থের মধ্য থেকে যে কোনো একটিকে অকাট্যভাবে একমাত্র সঠিক বিবেচনা করার সুযোগ নেই।
মূলকথা হলো: এখানে আয়াতের অর্থটা বাহ্যিক বা আক্ষরিকভাবে বুঝতে চাওয়াটা উচিত নয়। বরং আয়াতটির উদ্দেশ্য হলো অভিশপ্ত শয়তানকে এই কথা বলা যে– তুমি তোমার সমস্ত অস্ত্র দিয়ে আদমের সন্তানদের বিভ্রান্ত করতে কোমর বেঁধে নামো। তাদেরকে বিভ্রান্ত করতে তোমার সমস্ত সৈন্য আর কৌশলকে কাজে লাগাও। এত কিছুর পরেও তুমি আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দাদেরকে পথভ্রষ্ট করতে পারবে না।
ঙ) ‘ওয়া আনতুম সা-মিদূন’ শীর্ষক আয়াত:
এ সংক্রান্ত পঞ্চম দলীল হিসেবে সূরা নাজমের শেষ দিকের কয়েকটি আয়াতকে উপস্থাপন করা হয়। যেখানে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
أَفَمِنْ هَـٰذَا الْحَدِيثِ تَعْجَبُونَ – وَتَضْحَكُونَ وَلَا تَبْكُونَ – وَأَنتُمْ سَامِدُونَ
“তাহলে এসব কথায় কি তোমরা অবাক হয়ে যাচ্ছো? তোমরা হাসিঠাট্টা করছো, অথচ কাঁদছো না! তোমরা ‘সামিদূন’ হয়ে রয়েছো।” (সূরা নাজম: ৫৯-৬১)
ইবনে আব্বাস থেকে ইকরিমা বর্ণনা করেছেন, ইবনে আব্বাস বলেছেন: ‘সামাদা’ হলো গাধার স্বরে নিকৃষ্ট ভাষায় গান করা। যেমন– আরবীতে বলা হয়:اُسْمُدْ لَناَ (উস্মুদ লানা), অর্থাৎ আমাদেরকে গান শোনাও। যখন তারা কোরআন তেলাওয়াত শুনতো, তখন তারা গান গাইতো, হাসি-তামাশা করতো; যাতে করে তাদের কোরআন শুনতে না হয়।
কিন্তু আলোচ্য শব্দটি দিয়ে কী বোঝাচ্ছে এ সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন আরো ব্যাখ্যা রয়েছে। এমনকি স্বয়ং ইবনে আব্বাস থেকে আল-ওয়ালিবী ও আল-আওফী বর্ণনা করেছেন: ‘সামিদূন’ মানে হলো, উদাসীন, অবজ্ঞাকারী। এছাড়া কুরতুবী বলেছেন, আরবী ভাষায় শব্দটির ক্রিয়াপদের এই ব্যবহারটি খুব প্রসিদ্ধ: সামাদা–ইয়াস্মুদু–সুমূদান। যার মানে হলো: উদাসীন হওয়া, পাত্তা না দেয়া বা অবজ্ঞা করা। অন্যদিকে, দাহহাক বলেছেন, সামিদূন অর্থ উদ্ধত ও অহংকারী। আস-সিহাহ গ্রন্থে এসেছে: সামাদা–সুমূদান ক্রিয়াপদের অর্থ: অহংকারবশত মাথা উঁচু করে চলা। যে ব্যক্তি এভাবে চলাফেরা করে, তাকে বলা হয় সামিদ। আর কবি মুবাররিদ বলেছেন: সামিদূন অর্থ– যারা নিষ্ক্রিয় ও নির্লিপ্ত। কবি বলেছেন:
أتى الحدثان نسوة آل حرب بمقدور سمدن له سمودا
فرد شعورهن السود بيضا ورد وجههن البيض سودا
“ভাগ্যের ফেরে আলে হারবের নারীরা এমন বিপদের মুখোমুখি,
যা তাদের হতবুদ্ধি করে দিয়েছে।
ফলে তাদের কালো চুলগুলো সব সাদা হয়ে গেছে,
আর ফর্সা চেহারাগুলো হয়ে গেছে কালো।”
অর্থাৎ, এই কবিতায় এসে কবি সামাদা শব্দটিকে ভিন্ন একটি অর্থে ব্যবহার করেছেন।
আর এটা তো নির্ধারিত একটা বিষয় যে– কোনো দলীলে যদি শরীয়াহসম্মত একাধিক সঠিক অর্থের সম্ভাবনা থাকে, তাহলে এসব অর্থের মধ্য থেকে যে কোনো একটিকে অকাট্যভাবে একমাত্র সঠিক বিবেচনা করার সুযোগ নেই।
এই আয়াতকে যারা গান হারাম হওয়ার পক্ষের দলীল হিসেবে উপস্থাপন করেন, তাদের জবাবে ইমাম গাজ্জালী বলেছেন: তাদের দাবী অনুযায়ী গানকে হারাম হিসেবে মেনে নিলে তো হাসাহাসি করা তো হারাম হবেই, এমনকি কান্না না করাও হারাম! কারণ আয়াতটিতে এই ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: “তোমরা হাসিঠাট্টা করছো, অথচ কাঁদছো না!”
গাজ্জালী আরো বলেছেন: যদি বলা হয়ে থাকে, এই আয়াতটি তো মুসলমানদের ইসলাম গ্রহণের কারণে যারা হাসাহাসি করে, তাদের জন্য প্রযোজ্য। তাহলে এক্ষেত্রেও শুধু সেসব গান ও কবিতাই হারাম হবে, যেগুলো মুসলমানদেরকে উপহাস ও অবজ্ঞার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। যেমনটা আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: “বিভ্রান্ত লোকেরাই কবিদের অনুসরণ করে” (সূরা শোয়ারা: ২২৪)। এখানে অবশ্য আল্লাহ তায়ালা কাফির কবিদের কথা বুঝাতে চেয়েছেন। স্বয়ং কবিতাকে হারাম গণ্য করা আল্লাহর উদ্দেশ্য নয়।[22]
আলোচনার এই পর্যায়ে এসে আমরা দেখতে পাই– পবিত্র কোরআনে এমন একটা আয়াতও নেই, যাকে অকাট্য ও শর্তহীনভাবে গান হারাম হওয়ার পক্ষে দলীল হিসেবে উপস্থাপন করা যায়।
সমস্ত প্রসংশা মহান আল্লাহর, যিনি আমাদের সঠিক পথের দিশা দিয়েছেন। তিনি ব্যতীত কোনোভাবেই আমরা সঠিক পথের দিশা পেতাম না।
[মূল: ইউসুফ আল-কারযাভী, অনুবাদ: শাইখুল আবরার]
অনুবাদটির অন্যান্য পর্ব পাবেন এখানে
রেফারেন্স ও নোট:
[1] যেসব কাজ কোনো অন্যায় বা ফ্যাসাদের দিকে টেনে নিয়ে যায়, সেসব কাজে বাঁধা দেয়ার নীতিকে ‘সাদ্দ আয-যারাই’ বলা হয়। (দেখুন– আল-ওয়াজীয ফী উসূলিল ফিক্হ, ড.আব্দুল কারীম যায়দান, পৃ. ২৪৫, মুয়াসসাসাহ কুরতুবাহ।) — অনুবাদক
[2] দেখুন– ইমাম বায়হাকীর আস-সুনান আল-কুবরা (১০/২২৩)।
[3] যেসব হাদীসের সনদ (বর্ণনাকারীর ধারাবাহিকতা) কোনো ধরনের বিচ্ছিন্নতা ছাড়া সরাসরি রাসূল (সা) পর্যন্ত পৌঁছেছে, সেসব হাদীসকে মুসনাদ হাদীস বলা হয়। বিস্তারিত জানতে দেখুন– তাইসীরু মুসতালাহিল হাদীস, ড. মাহমুদ আত-তাহ্হান, ১১তম সংস্করণ, পৃ. ১৬০-১৬১, মাকতাবাতুল মা’আরিফ। — অনুবাদক।
[4] কোনো কথা, কাজ, মৌন সম্মতি, গুণ বা বৈশিষ্ট্যকে সরাসরি রাসূলের (সা) সাথে সম্পর্কিত করাকে মারফু হাদীস বলে। যেমন– ওমর (রা) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসের কথা বলা যায়। তিনি বলেন, রাসূল (সা) বলেছেন: “নিশ্চয়ই সকল কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল।” বিস্তারিত জানতে দেখুনঃ তাইসীরু মুসতালাহিল হাদীস, ড. মাহমুদ আত-তাহ্হান, ১১তম সংস্করণ, পৃ. ১৬০-১৬১, মাকতাবাতুল মা’আরিফ।— অনুবাদক।
[5] ইগাসাতু আল-লাহ্ফান মিন মাসায়িদ আশ-শায়তান, ইবনুল কায়্যিম, প্রথম খণ্ড, পৃ. ২৫৭-২৫৯, মুস্তাফা আল-হালাবী প্রকাশনী।
[6] প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫৭; আরো দেখুন– সুনানে বায়হাকী (১০/২২৩), ইমাম বায়হাকী তাঁর সুনান গ্রন্থে এ প্রসংগে মুজাহিদ ও ইকরিমার পাশাপাশি ইবরাহীম আন-নাখয়ীর নামও উল্লেখ করেছেন।
[7] যেসব কার্যকরণ ও প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে কোরআনের আয়াত নাজিল হয়েছে, সেসব প্রেক্ষাপট ও কার্যকারণকে ‘সাবাব আন-নুজুল’ বলা হয়। এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, সেসব কার্যকারণ, প্রেক্ষাপট বা ঘটনাগুলো অতি অবশ্যই শরীয়াহর মূলনীতিকে সামনে রেখে বিশুদ্ধ পদ্ধতিতে বর্ণিত হতে হবে। বিস্তারিত জানতে দেখুন– মাবাহিস ফী ঊলূমিল কোরআন, মান্না’ আল-কাত্তান, পৃ. ৭১-৯১, মাকতাবাহ ওয়াহবাহ। — অনুবাদক
সেমা/সংগীতের প্রশংসা ও সমর্থনসূচক নিচের কিতাব গুলি দেখুনঃ
> ইহইউয়াউল উলুম কিতাবে (লিখকঃ ইমাম
গাজ্জালী রঃ ),
> আওয়ারিফ কিতাবে (বলছেনঃ শেখ সাহাব উদ্দিন সোহরাওয়ার্দী (রঃ ),
> ইজাজ কিতাব (ইমাম আবু হানিফা রঃ এর সমর্থন),
> কশফ কিতাবে, ওমদাতুলকারী কিতাবে (ইমাম মালেক রঃ,
ইমাম শাফী রঃ, ইমাম আহমদ হাম্বল রঃ, হযরত দাউদ তায়ী রঃ সেমার সমর্থন এর রেফারেন্সগুলি উল্লেখ করছেন)
> মসনবি শরীফ কিতাবে (লিখকঃ জালাল উদ্দিন রুমি (রঃ ),
> বোস্তান কিতাবে (লিখকঃ শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদী রঃ ),
সেমা/সংগীতের প্রতি অনুরাগী ছিলেনঃ
> হজরত সুফি আন নুরী (রঃ),
> হজরত শামস তাবরীজ (রঃ),
> মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (রঃ ),
> হজরত আবদুর রহমান জামী (রঃ),
> হজরত হাফেজ সিরাজী (রঃ),
> হজরত খাজা গরিবে নেওয়াজ(রঃ),
> হজরত শেখ সাদী (রঃ),
> হজরত আমীর খসরু (রঃ),
> হজরত ফরিদ উদ্দিন (রঃ),
> হজরত নিজাম উদ্দিন(রঃ),
> হজরত কুতুব উদ্দিন (রঃ)
সেমা/সংগীতের প্রতি প্রশংসা ও সমর্থন ছিলেনঃ
> ইমাম আবু হানিফা (রঃ),
> ইমাম মালেক (রঃ),
> ইমাম শাফী (রঃ),
> ইমাম আহমদ হাম্বল (রঃ),
> হযরত দাউদ তায়ী (রঃ),
> হজরত জুনাইদ বোগদাদী (রঃ),
> হজরত ইমাম গাজ্জালী (র:);
> হজরত আবদুল কাদের জিলানি (রঃ),
> হজরত মহি উদ্দিন ইবনুল আরাবী (রঃ),
> শেখ সাহাব উদ্দিন সোহরাওয়ার্দী (রঃ),
> শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদী (রঃ) এবং আরো অনেক ওলী আল্লাহ ।
এরই ধারাবাহিকতায় চীশতিয়া,মৌওলবিয়া,সোরোয়ারদীয়া, মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফে সেমা/সংগীতের প্রচলন আছে ।
Many many thanks dear Sabuktogin mama for producing some strong documents as well as refrences of Hadith for Sema sangith (kawali). I feel that kawali / Sema sangith may easlily attract the general people towards Islam and Sufism .Which is not possible by waz/ lecture.
ReplyDeleteThere are more and more references of Sema sangith with Dof during the time of Rasul Sallala hu Alihi wa Sallam. More over most of the Aulia e qiram of all Tarikas was fond of Sema songs / kawali.
So It is a most authentic way to enjoy Sema song as well as it may influenced and attract the general people towards Islam.
Again Thanks Mama for producing such authentic documents and references regarding kawali.
Best regards.
S.A. Gafur.( Fujayel)
ধন্যবাদ, আপনাকে উপলব্ধি মূলক বিশ্লেষণ করার জন্য। ছেমা একটি আত্মার খোরাক,এটা ফরজ নয়,আদবের সহিত শর্ত অনুযায়ী ছেমা করা দোষের নয়।আপনি করলেন না সমস্যা নাই। কিন্তু ছেমার নামে অপবাদ দেওয়া জ্ঞানহীনতার কাজ ছাড়া কিছু নয়।
ReplyDelete