মাসালায়ে ইলমে তরিকত।


‘কদম’ অর্থ পদ বা পা; বুছি অর্থ ‘চুম্বন’। কদমবুছির অর্থ হল ‘পদচুম্বন করা’।
কদমবুছি করা আদব। যাদেরকে কদমবুছি করা আদবের ভিতরে পরে....
• মা-বাবাকে কদমবুছি করা,
• গুরুজনদের কদমবুছি করা,
• শিক্ষক ও ওস্তাদকে কদমবুছি করা,
• পীর মাশায়েখকে কদমবুছি করা ইত্যাদি।
কদমবুছি শরিয়তসম্মত ও গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। একে না জায়েজ বা শেরকি বলা অন্যায়।
দলিল নং-১
পবিত্র হাদিস শরীফে আছে,“হযরত জারেইন (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বনী কায়েছ গোত্রের প্রতিনিধি ছিলেন।
তিনি বলেন, যখন আমরা মদিনায় আগমন করলাম, দ্রুতগতিতে ছাওয়ারী থেকে নামলাম। অতঃপর আল্লাহর নবী (সাঃ) এর হাত মোবারকে চুম্বন করলাম ও তাঁর কদম মোবারকে চুম্বন করলাম।”
তথ্যসূত্রঃ
• সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং5135 ইফা;
• বায়হাক্বী শরীফ, হাদিস নং-১৩৫৮৭;
• ফাতহুল বারী শরহে বুখারী, ৮ম খন্ড;
• মেসকাত শরীফ, হাদীস নং৪৬৮৮;
• আল আদাব লীল বায়হাক্বী, হাদিস নং-২২৬।
দলিল নং-২
হযরত ছাওফান ইবনে আছ্ছাল (রাঃ) বলেন, নিশ্চয় একদল ইয়াহুদী নবী করিম (সাঃ)এর হাত মোবারক ও কদম মোবারকে চুম্বন করেছেন।”
তথ্যসূত্রঃ
• তিরমিজি শরীফ, হাদীস নং২৭৩৩;
• সুনানে নাসাঈ, হাদিস নং-৪০৭৮;
• সুনানে ইবনে মাযাহ, হাদীস নং ৩৭০৫,
• মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ১৮০৯২;
• মুস্তাদরাকে হাকেম, হাসিদ নং ২০।
দলিল নং- ৩
হযরত ওয়াজে ইবনে আমের (রাঃ) বলেন, আমরা দয়াল নবীজীর কাছে আগমন করলাম।
কেউ একজন বললেন, এই যে আল্লাহর রাসূল (দঃ)! অতঃপর আমরা নবী পাকের মোবারক হস্তদয় ও পদদ্বয় ধরে চুমু খেলাম।”
তথ্যসূত্রঃ
* আল- আদাবুল মুফরাদ, হাদিস নং৯৭৫ কৃতঃ ইমাম বুখারী)।
দলিল নং-৪
হযরত ছুহাইব (রাঃ) বলেন, “নিশ্চয় আমি হযরত আলী (আঃ) কে হযরত আব্বাস (রাঃ) এর হস্ত ও পদ চুম্বন করতে দেখেছি।”
তথ্যসূত্রঃ
• আল- আদাবুল মুফরাদ, হাদিস নং ৯৭৬
• কানযুল উম্মাল, হাদীস নং ৩৭৩৩০
দলিল নং-৫
হযরত বুরাইদা (রাঃ) বর্ণনা করেন, একদা এক আরাবী লোক রাসূলে পাক (সাঃ) এর কাছে একটি নিদর্শন চাইলেন।
দয়াল নবীজি (দঃ) বললেন, ঐ গাছটিকে বল, আল্লাহর রাসূল (দঃ) তাকে ডেকেছে। অতঃপর সে তাই করল এবং ঐ গাছটি ডানে-বামে, সামনে-পিছনে ঝুকে পরল ও শিকর ভেঙ্গে উঠে এসে নবী করিম (দঃ) এর সামনে দাঁড়ালো।
অতঃপর গাছটি বলতে লাগল: আস-সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ!...
তখন আরাবী লোকটি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে অনুমতি দিন যেন আপনাকে সেজদা করি। প্রিয় নবীজী (দঃ) বললেন, যদি আল্লাহ্ ব্যতীত কাউকে সেজদা করার অনুমতি থাকতো তবে প্রত্যেক স্ত্রীকে তার স্বামীর প্রতি সেজদা করার অনুমতি দিতাম।
আরাবী লোকটি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাহলে আপনাকে কদমবুছী করার অনুমতি দিন। অতঃপর প্রিয় নবীজি (দঃ) তাকে অনুমতি দিলেন।”
তথ্যসূত্রঃ
• শিফ শরীফ, ১ম খন্ড,
• মাদারেজুন নবুয়ত, ১ম খন্ড;
• মুস্ততাদরাকে হাকেম, হাদিস নং৭৩২৬।
কাজেই পরিস্কারভাবে বুঝা গেল যে কদমবুছি রাসূলে পাক (সাঃ) এর একটি সুন্নত। যারা কদমবুছীর পক্ষে তারা মূলত রাসূলে পাক (দঃ) ও সাহাবায়ে কেরামের পক্ষে এবং যারা কদমবুছীর বিপক্ষে তারা মূলত রাসূলে পাক (দঃ) ও সাহাবায়ে কেরামের বিপক্ষে এবং পথভ্রষ্ট।।

🌿 মাযারে ফুল অর্পন, গিলাফ চড়ান ও বাতি জ্বালানো🌹

মাযার জিয়ারাত।
নোট ০১.
মূল আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে একটি বিষয়ে সকলের বিশেষভাবে মনেযোগ আকর্ষন করছি আর তা হল কবর থেকে ``ফয়েজ হাসিল করা`` সংক্রান্ত।

আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে, কবর থেকে ফয়েজ হাসিলের বিষয়টিতে উলামায়ে দেওবন্দ ও উলামায়ে আহলে সূন্নাত এর মধ্যে মতপার্থক্য নেই।
উলামায়ে কথিত আহলে হাদিসও মতপার্থক্য মুক্ত থাকার কথা।
কিন্তু বর্তমান কথিত আহলে হাদিস মৌলভীরা নুতনকরে মতপার্থক্য সৃষ্টি করলে তা তাদের জন্য হবে স্ববিরোধীতা।

প্রাচীণ মুসলিম স্কলারদের আক্বিদা :

হাযরাত ইবনে হাযর আসকালানী র.'র ভাষ্য:

সহীহ বুখারিতে ইমাম বুখারী এক অনুচ্ছেদের শিরোনাম দিয়েছেন بَابُ مَا جَاءَ فِي قَبْرِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَبِي بَكْرٍ وَعُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا।
এই অনুচ্ছেদের অধীনে ইমাম বুখারী রাহ. উমর রা.এর ঐ হাদীস উল্লেখ করেছেন, যাতে তিনি ইবনে উমর রা.এর মাধ্যমে আম্মাজান আয়েশা রা.এর কাছে রাসুল সল্লাল্লহু আ'লাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম এর কবরের পাশে শায়িত হওয়ার অনুমতি চেয়ে ছিলেন।
আম্মাজান আয়েশা সিদ্দিকা রা. বলেন, “আমি এই জায়গা আমার (দাফনের) জন্য পছন্দ করে রেখে ছিলাম।
কিন্তু আমি তা উমরকে দিয়ে দিলাম।”
সহীহ বুখারীর ভাষ্যকার হাফেয ইবনে হজর আসকালানী রাহ. এই হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেন :
وفيه الحرص على مجاورة الصالحين في القبور طمعا في إصابة الرحمة إذا نزلت عليهم وفي دعاء من يزورهم من أهل الخير
‘এই হাদীসের মাঝে এই কথার প্রমাণ পাওয়া যায় যে, কবরে নেককারদের সাথে প্রতিবেশীত্ব (পাশাপাশি শয়ন) লাভ করার কামনা করা উচিৎ এই নিয়তে ও আশায় যে, নেককারদের উপর বর্ষিত রহমত যেন তাঁর কাছেও পোঁছে।
আর নেক লোক যখন তাঁর কবর যিয়ারত করে ও তাঁর জন্য দুআ করে সেও রহমতের অংশ লাভ করে।
📘 গ্রন্থ সূত্র :
*_* ফাতহুল বারী, ৩/২৫৮।

সহীহ বুখারীর এই বিজ্ঞ ভাষ্যকারের বক্তব্য থেকে হয়ত বিচক্ষন পাঠক বুঝতে পেরেছেন যে, এটি আসলে বিদআত ও শিরক নয়।

কথিত আহলে হাদিস আলেম এই মতিউর রহমান হিন্দুস্থানী “হাদাহুল্লাহু” কবর থেকে ফয়েজ আসে এমন আকীদাকে তার এক লেকচারে শিরক বলেছে।
বর্তমান কথিত আহলে হাদীসদের আকীদাও তাই। আর সে গোমরাহ মুখো সাথে সাথে এও বলেছে যে, দেওবন্দীরা এই শিরকী আকীদা রাখে।
তার ল্যাকচারে সে কয়েকজন দেওবন্দী আলেমের নামও উল্লেখ করেছে।
কিন্তু সে এখানে যে খেয়ানত করেছে তাহলো, আহলে হাদীস অনেক আকাবির আলেমও এই শিরকী (তাদের মতে) আকীদা রাখেন।
কিন্তু সে তাদের নাম উল্লেখ করে নি।

এখানে শুধু আহলে হাদীস ফেরকার দুইজন বানীর (প্রতিষ্ঠাতার) নাম ও তাদের বক্তব্য উল্লেখ করছি-যাদের হাত ধরে কথিত বর্তমানের এই আহলে হাদিস বাতীল ওহহাবী ফির্কা।

❖ কথিত আহলে হাদীস ফেরকার প্রতিষ্ঠাতা নবাব সিদ্দীক হাসান খান স্বীয় কিতাব “আত তাজুল মুকাল্লিল”এ তার পিতা আবু আহমাদ হাসান বিন আলী আল হুসাইনীর স্মরণে লিখেন :
ولا يزال يري النور على قبره الشريف والناس يتبركون به
“তার কবর শরীফে সর্বদা নুর থাকে। আর লোকজন তার কবর থেকে বরকত লাভ করে।”
📘 গ্রন্থ সূত্র :
*_* আত তাজুল মুকাল্লিল, পৃষ্ঠা-৫৪৩, মাক্তাবাতুস সালাম।

❖ ফেরকায়ে আহলে হাদীসের আরেকজন প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা ওয়াহিদুজ্জামান বলেন,
ولا ازال السلف والخلف يتبركون باثار الصلحاء ومشاهدهم ومقاماتهم و ابارهم وعيونهم ولم يقل احد ان التبرك بمثل هذه الاشياء شرك
সালাফ ও খালাফগন (পূর্বসূরি ও উত্তরসূরিগণ) নেককারদের নিদর্শন, কবর, স্থান, কুপ-ঝর্না সমূহ থেকে বরকত লাভ করে থাকেন। কেও একথা বলেন না যে, এগুলো থেকে বরকত লাভ করা শিরক।
তিনি আরও বলেন :
قلت بهذا يدفع الشبهة التي اوردها القاصرون انه كيف يمكن استحصال الفيوض و البركات وبرد القلب والانوار من قلب انوار الصلحاء بزيارة قبورهم
এর দ্বারা ঐ সন্দেহেরও নিরসন হয় যা কিছু স্বল্প জ্ঞানসম্পন্ন লোকজন বলে থাকে যে, “নেককারদের কবর যিয়ারত করে তাদের রুহ সমূহ থেকে ফয়েজ, বরকত ও নুর সমূহ লাভ করা কি করে সম্ভব?”
📘 গ্রন্থ সূত্র :
*_* হাদিয়াতুল মাহদী, পৃষ্ঠা-৩২,৩৩,৩৪।

এবার আমরা মূল আলোচনার প্রয়াস পাচ্ছি; আসুন দেখি,

❑ আল্লাহর ওলীগণ ও তাদের মাযারসমূহ আল্লাহর নিদর্শন এবং আল্লাহর নিদর্শনসমূহ অর্থাৎ ধর্মের নিশান সমূহের সম্মান করার জন্য কুরআনী নির্দেশ রয়েছে।
যেমন :
 وَمَنْ يُّعَظِّمْ شَعَائِرَ اللهِ فَاِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوْبِ (
কেউ আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে সম্মান করলে, এ-তো তার হৃদয়ের তাকওয়া সজ্ঞাত।

এ সম্মানের বেলায় কোন শর্তারোপ করা হয়নি।
এক এক দেশে এক এক ধরণের রীতি প্রচলিত আছে।

যেই দেশে এবং যেই সময়ে যে ধরণের বৈধ তাযীম প্রচলিত আছে, সেই মতে করা যায়েয।

তাঁদের কবরসমূহে ফুল অর্পন চাদর চড়ান ও বাতি জ্বালানো ইত্যাদির উদ্দেশ্য সম্মান প্রদর্শন, তাই এগুলো জায়েয।

তাজা ফুলে যেহেতু এক প্রকার জীবন আছে, সেহেতু ওটা তসবীহ তাহলীল করে। যার ফলে কবরবাসি ছওয়াব পেয়ে থাকেন অথবা তাঁর শাস্তি হ্রাস পায় এবং যিয়ারতকারীগণ এর থেকে সুঘ্রাণ লাভ করে। তাই এটা প্রত্যেক মুসলমানের কবরের উপর আর্পন করা জায়েয। এর তাসবীহের বরকতে কবরবাসির আযাব হ্রাস পায়।

❖ এর প্রমাণ মিশকাত শরীফের ادابالخلاء অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদে সেই হাদীছে রয়েছে, যেখানে বর্ণিত আছে একবার হুযুর আলাইহিস সলাম দু’কবরের পাশ দিয়ে যাবার সময় ইরশাদ ফরমান কবরবাসির আযাব হচ্ছে। এদের মধ্যে একজন প্রস্রাবের ছিটা থেকে সতর্ক থকতো না এবং অপরজন পরনিন্দা করতো।
ثُمَّ اَخَذَجَرِ يْدَةً رَطْبَةً فشقَّهَا نِصْفَيْنِ ثُمَّ غَرَز فِىْ كُلِّ قَبْرٍ وَاحِدَةً قَالُوْا يَارَ سَوْلَ اللهِ لما صَنَعْت هَذَا فَقَالَ لَعَلَّهَ اَنْ يّخَفَّفَ عَنْهُمَا مَالَمْ يَيْبِسَا
অত:পর তিনি সল্লাল্লহু আ'লাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম একটি কাঁচা ডাল নিয়ে তা দু’ভাগ করে দু’কবরে গেড়ে দিলেন। সাহাবাগণ আরয করলেন-ইয়া রাসুলাল্লাহ, আপনি এরকম কেন করলেন? তখন তিনি বললেন, যতক্ষণ পর্যন্ত এ ডাল না শুকাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ওদের আযাব কম হবে।

❖ এ হাদীছের ব্যাখ্যা প্রসংগে ইমাম নববী (রহ:) বলেন।
وَقِيْلَ اِنَّهُمَا يُسَبِّحَنِ مَادَامَ رَطَبَتَيْنِ وَاسْتَحَبَّ الْعُلَمَاءُ قِرْءَةَ الْقُرْ اَنِ عِنْدَ الْقَبْرِ لِهَذَالْحَدِيْثِ اِذْ تِلَاوَتُ الْقُرْ اَنِ اَوْلَى بِالتَّخْفِيْفِ مِنْ تَسْبِيْحِ الْجَرِيْدِ
যতক্ষণ পর্যন্ত ডাল কাঁচা থাকবে ততক্ষণ তসবীহ পাঠ করবে। এ জন্য আযাব কম হবে। এ হাদীছের উপর ভিত্তি করে উলামায়ে কিরাম কবরের পার্শ্বে কুরআন পাঠ করাকে মুস্তাহাব বলেছেন। কেননা আযাব কমানোর বেলায় ডালের তসবীহ থেকে কুরআন তিলাওয়াতের গুরুত্ব অনেক বেশী।

❖ আশআতুল লুমআত গ্রন্থে এ হাদীছের প্রেক্ষাপটে উল্লেখিত আছে-
تمسك كنند جماعت به ايں حديث دراند اختن سبزہ وگل ريحان بر قبور
একটি জামাত এ হাদীছকে কবর সমূহে কাঁচা ফুল ও সুগন্ধি দেয়ার বৈধতার দলীল হিসেবে পেশ করে থাকেন।
এ হাদীছের ব্যাখ্যায় মিরকাতে বর্ণিত আছে-
“বোঝা গেল যে, মাযারে ফুল দেয়া সুন্নাত”।

প্রসিদ্ধ তাহতাবী আলা মারাকিল ফলাহ কিতাবের ৩৬৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখিত আছে-
قَدْ اَفْتَى بَعْضُ الْاَئِمَّةِ مِنَ مُتَاخِّرِىْ اَصحَابِنَا بِاَنَّ مَااعْتِيْدَ مِنْ وَضَعِ الرِّيْحَانِ وَالْجَرِيْدِ سُنَّةً بِهَذَا الْحَدِيْثِ
“আমাদের উলামায়ে কিরাম এ হাদীছ থেকে ফতওয়া দিয়েছেন যে, কবরে সুগন্ধি ও ফুল অর্পনের যে রীতি আছে, তা সুন্নাত”।
উল্লেখ্য যে,
উপরোক্ত ইবারত সমূহ “কতেক আলিম ফতওয়া দিয়েছেন” এর ভাবার্থ কেবল জায়েয বলা নয়, বরং এর ভাবার্থ হচ্ছে কতেক আলিম একে সুন্নাত মনে করেছেন।
কেননা জায়েযত সবাই বলেন, কেবল সুন্নাত বলার ক্ষেত্রে মতভেদ রয়েছে।

❖ ফতওয়ায়ে আলমগীরী কিতাবুল কারাহাত পঞ্চম খন্ড زيارت القبور শীর্ষক অধ্যায়ে উল্লেখিত আছে-
وَضْعَ الْوُرَوْدِ والرِّيَاجَيْنِ عَلَى الْقَبُوْرِ حسن
“কবর সমূহের উপর ফুল ও সুগন্ধি রাখা উত্তম” ।

❖ ফতওয়ায়ে শামীর زيارت القبور শীর্ষক আলোচনায় উল্লেখ আছে-
وَيُوْحَذُ مِنْ ذَالِكَ وَمِنَ الْحَدِيْثِ نَدْبُ وَضْعِ ذَالِكَ لْاِتْبَاعِ وَيُقَاسُ عَلَيْهِ مَااعْتِيْدَ فِىْ زَمَانِنَا مِنْ وَضْعِ اَغْصَانِ الْاَسِ وَنَحْوِهِ
এ হাদীছ ও অন্যান্য হাদীছ থেকে ওই সমস্ত জিনিস কবরের উপরে রাখাটা মুস্তাহাব বোঝা যায় এবং এ সুবাদে কবরের উপর খেজুর গাছের ডাল ইত্যাদি দেওয়াটা, যা আমাদের যুগে প্রচলিত আছে, তা মুস্তাহাব বলা যাবে।

❖ একই স্থানে শামীতে আরও উল্লেখিত আছে-
وَتَعْلِيْلُهُ بِالتَّخْفِيْفِ عَنْهُمَا مَالَمْ يَيْبِسَا اَىْ يُخَفَّفُ عَنْهُمَا بِبَرْكَةِ تَسْبِيْحِهِمَا اِذْ هُوَ اكْمَلُ مِنْ تَسْبِيْحِ الْيَابِسِ لِمَافِى الْاَخْضَرِ نَوْعُ حَيَاةٍ
শুকনা না হওয়াটাই হচ্ছে আযাব কম হওয়ার কারণ অর্থাৎ ওইসবের তাসবীহের বরকতে কবর আযাব কম হবে, কেননা কাঁচা ডালের তসবীহ শুকনা ডালের তসবীহ থেকে বেশী কার্যকর। কারণ ওটাতে এক প্রকার জীবন আছে।

উপরোক্ত হাদীছ, মুহাদ্দেছীন ও ফকীহগণের ইবারতসমূহ থেকে দুটি বিষয় জানা গেলো :
০১. একটি হচ্ছে প্রত্যেক মুসলমানের কবরে সজীব বস্তু রাখা জায়েয। হুযুর আলাইহিস সালাম ঐ দু-কবরের উপর ডাল পুঁতে দিয়েছিলেন, যাদের আযাব হচ্ছিল।

০২. দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে আযাব কম হওয়াটা কেবল হুযূর আলাইহিস সালামের দুআর কারণে নয় বরং এটা সজীব বস্তুর বরকতের ফল।
যদি কেবল দুআয় আযাব কম হতো, তাহলে হাদীছে শুকনা হওয়ার শর্তারোপ কেন করা হলো?
তাই, আজকাল আমরাও যদি ফুল ইত্যাদি অর্পন করি, তাতেও ইনশাআল্লাহ কবরবাসির উপকার হবে। সাধারণ মুসলমানদের কবর কাঁচা রাখার এটাও একটা অভিপ্রায় যে বর্ষাকালে এর উপর সবুজ ঘাস জন্মাবে এবং এর তসবীহের বরকতে কবরবাসির আযাব কম হবে।

অতএব, প্রমাণিত হলো, প্রত্যেক মুসলমানের কবরে ফুল ইত্যাদি অর্পন জায়েয।

মৌলভী আশরাফ আলী সাহেব ‘ইসলাহুর রুসুম’ গ্রন্থে লিখেছেন : ফুলমূল ইত্যাদি পাপী তাপীদের কবর সমূহে অর্পন করা উচিৎ, আওলিয়া কেরামের কবরে নয়।
কেননা তাঁদের মাযার সমূহে আযাব হয় না।
কথা ঠিক, তবে জেনে রাখা দরকার যে, যেই আমলসমূহ পাপীদের পাপ হ্রাস করে, তা নেকবান্দাদের পদ মর্যাদা বৃদ্ধির সহায়ক করে।
যেমন মসজিদের দিকে যাত্রা করলে আমাদের গুনাহ মাফ হয়।
আর নেকবান্দাদের পদমর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
কিন্তু ওনার যুক্তি থেকে এটাই প্রকাশ পায় যে, নেকবান্দাগণ যেন মসজিদে না আসেন এবং মাগফিরাতও কামনা না করেন, কেননা তাঁরা গুনাহ থেকে পবিত্র।
যাহোক, ঐসব ফুলের তসবীহের বরকতে তাঁদের কবরে খোদার রহমত আরও বৃদ্ধি পায়, যেমন কুরআন তিলাওয়াতের ফলে হয়ে থাকে।

✏ আওলিয়া কিরামের কবরের উপর চাদর বা গিলাফ চাড়ানো জায়েয, কেননা এর ফলে যিয়ারতকারীদের কাছে ছাহেবে কবরের মর্যাদা প্রকাশ পায়।
দেখুন :
❖ ফতওয়ায়ে শামীর ৫ম খন্ডে কিতাবুল কারাহিয়া اللبسশীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-
ফতওয়ায়ে হুজ্জাতে আছে যে, কবরে গিলাফ চড়ানো মাকরূহ। কিন্তু আমি বলতে চাই যে, বর্তমান কালে যদি সাধারণ লোকের দৃষ্টিতে সম্মানবোধ প্রত্যাশা করা হয়, যাতে কবরবাসীর প্রতি অবজ্ঞা করা না হয় বরং উদাসীন ব্যক্তিদের মনে আদব ও ভয়ের সৃষ্টি হয়, তাহলে গিলাফ চড়ান যায়েয। কেননা আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল।
ফতওয়ায়ে শামীর এ ইবারত থেকে বোঝা গেল যে, আল্লাহর ওলীগনের শান-মান প্রকাশ করার জন্য যে কোন বৈধ কাজ জায়েয।
গিলাফ চড়ানোর গোড়ার কথা হলো যে, হুযুর সল্লাল্লহু আ'লাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম'র পবিত্র যুগেও পবিত্র কাবা ঘরে গিলাফ ছিল। তিনি সল্লাল্লহু আ'লাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম এটা নিষেধ করেননি। শত শত বছর থেকে হুযুর আলাইহিস সালামের রওযা পাকের উপর সবুজ রং এর রেশমী চাদর চড়ানো আছে, যা খুবই মূল্যবান। আজ পর্যন্ত কেউ একে নাজায়েয বলেননি।
মকামে ইব্রাহীম অর্থাৎ যেই পাথরের উপর দাঁড়িয়ে হযরত খলীল (আ:) কাবা শরীফ তৈরী করেছিলেন, সেই পাথরের উপরও গিলাফ চড়ানো আছে এবং ইমারত তৈরী করা হয়েছে। খোদার কি শান! নজদী ওহাবীরাও ওগুলোকে পূর্ববৎ রেখে দিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন হলো, এগুলোর উপর কেন গিলাফ চড়ানো হলো? নিশ্চয় এসবের মর্যাদার জন্য তা করা হয়েছে। অনুরূপ আওলিয়া কিরামের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য তাদের কবর সমূহের উপরও গিলাফ ইত্যাদি রাখা মুস্তাহাব।

❖ সূরা-তাওবার ১৮নং আয়াত اِنَّمَا یَعْمُرُ مَسَاجِدَ اللّٰہِ এর তাফসীর করতে যেয়ে তাফসীরে রুহুল বায়ানের ১০ম পারার মধ্যে আল্লামা ইসমাঈল হক্কী (রহঃ) বর্ণনা করেন যে :
فَبِنَاءَ الْقُبَّابِ عَلٰی قُبُوْرِ الْعُلَمَاءِ وَالْاَوْلِیَاءِ وَالصُّلَحَاءِ وَوَضَعَ السُّتُوْرَ وَالْعَمَاءِمِ وَالثِیَابِ عَلٰی قُبُوْرِہِمْ اَمْرٌ جَاءِزٌ اِذَا کَانَ الْقَصْدُ بِذٰلِکَ التَّعْظِیْمِ فِیْ اَعْیُنِ الْعَامَّۃِ حَتّٰی لَا یَحْتَقِرُوْا صَاحِبُ ہٰذَا الْقَبْرِ وَکَذَا اِیْقَادُ الْقَنَادِیْلٍ وَالشَّمْعِ عِنْدَ قُبُوْرٍ الْاَوْلِیَاءِ وَالصُّلَحَاءِ مِنْ بَابِ التَّعْظِیْمِ وَالْاِجْلَالِ اَیْضًا لِلْاَوْلِیَاءِ فَالْمَقْصُوْدُ فِیْہَا مَقْصَدٌ حَسَنٌ وَنَذَرَ الزَّیْتَ وَالشًّمْعَ لِلْاَوْلِیَاءِ یُوْقَدُ عِنْدَ قُبُوْرِہِمْ تَعْظِیْمًا لَہُمْ وَمُحَبَّۃً فِیْہِمْ جَاءِزٌ اَیْضًا لَا یَنْبَغِیْ النَّہِیَ عَنْہُ
[تفسیر روح البیان : (سورۃ : التوبۃ ایۃ : ۱۸) جلد ۳ /صفحۃ ۱۶۶۶/ہجری : ۱۴۲۶ ۱۴۲۷ 249 عسائی : ۲۰۰۶ / بیروت 249 لبنان ]
অর্থাৎ : আউলিয়া কেরাম, ছালেহীন ও ওলামাগণের কবরের উপরে গুম্বুজ স্থাপন করা এবং সাধারণ লোকজন যেন মাযারস্ত আউলিয়াগণকে হীন মনে না করে, এই উদ্দেশ্যে তাঁদের মাযার সমূহে সামিয়ানা, পাগড়ী ও গিলাফ দ্বারা আবৃত করা (শরিয়ত মতে) বৈধ বা জায়েজ। অনুরুপভাবে সম্মান ও মর্যদা প্রদর্শনার্থে আউলিয়ায়ে কেরাম ও ছালেহীন গনের মাযারের উপর ঝালর বাতি লটকানো ও প্রদ্বীপ জ্বালানো জায়েজ। কেননা এ কাজের উদ্দেশ্য মহৎ। আউলিয়া কেরামের মাযারে জ্বালানোর উদ্দেশ্য তৈল ও প্রদিপ মান্নত করাও জায়েজ। কেননা, এর উদ্দেশ্য হচ্ছে মাযারের অলিগণের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ও তাঁদের প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন। এই কাজে নিষেধ করা বা বাধা দেয়া অনুচিৎ।
📘 গ্রন্থ সূত্র :
*_* তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ (সূরা - আত্ তাওবাঃ আয়াত - ১৮) ৩য় খণ্ড, ১৬৬৬ পৃষ্ঠা, (১৮২৬ – ২৭ হিজরী, ২০০৬ খৃষ্টাব্দ, বাইরুত, লেবানন ছাপা।

✏ সাধারণ মুসলমানদের কবরে প্রয়োজনবোধে এবং আল্লাহর ওলীদের মাযারসমূহে তাদের শান-মান প্রকাশার্থে বাতি জ্বালানো জায়েয।
দেখুন :
❖ প্রসিদ্ধ কিতাব হাদিকায়ে নদিয়া শরহে তরীকায়ে মুহাম্মদীয়া (মিসরী) দ্বিতীয় খন্ডের ৪২৯ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে :
"কবরসমূহে বাতি নিয়া যাওয়া বিদআত এবং অপব্যয়। অনুরূপ ফতওয়ায়ে বযাযিয়াতেও উল্লেখিত আছে যে, এসব নির্দেশ তখনই প্রযোজ্য, যখন অনর্থক করা হবে।
কিন্তু যদি কবরস্থানে মসজিদ হয় বা কবরটা রাস্তার পার্শ্বে হয় বা ওখানে কেউ বসে আছেন এমন হয়, অথবা যদি কোন ওলী বা কোন বিশিষ্ট আলিমের কবর হয়, তাহলে তাঁদের আত্মার প্রতি সম্মানের জন্য এবং জনগণের অবগতির জন্য, যাতে এটা ওলীর কবর বুঝতে পেরে ফয়েয হাসিল করতে পারে ওখানে বসে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে পারে, বাতি জ্বালানো জায়েয।
স্মরন রাখতে হবে যে, মহান আল্লাহ্ পাকের বন্ধুগনের কবর মুবারাক ফুয়ুজাত হাসিলের স্থান। আল্লাহ্'র বান্দাগনের শারিয়াত সমর্থিত যিয়ারতের স্থান"।

❖ তাফসীরে রূহুল বয়ানে দশ পারায় সূরা তওবার আয়াত- اِنَّمَايَعْمُرُ مَسْجِدَ اللهِ এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে উল্লেখিত আছে :
"অনুরূপ আওলিয়া কেরাম ও পূণ্যাত্মাদের কবরের কাছে তাঁদের শান-মানের জন্য প্রদীপ ও মোমবাতি জ্বালানো যেহেতু সঠিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত, সেহেতু জায়েয এবং আওলিয়া কিরামের (মাযারের) জন্য তৈল ও মোমবাতি বা তাঁদের কবরের পার্শ্বে তাদেরই সম্মানার্থে জ্বালানো হয়। এ উদ্দেশ্যে মানত করা জায়েয। এ ব্যাপারে নিষেধ না করা উচিত।
আল্লামা নাবলুসী (রহ:) স্বরচিত ‘কাশফুন নূর আন আসহাবিল কুবুর’ পুস্তিকায় একই বক্তব্য লিপিবদ্ধ করেছেন। বিবেকও তাই বলে। অর্থাৎ এসব কাজ জায়েয, যেমন গম্বুজের আলোচনায় বলা হয়েছে যে ওসব আওলিয়া কিরামের মাযারের শান-শওকতের দ্বারা প্রকৃত পক্ষে ইসলামেরই শান-শওকত প্রকাশ পায়। ওয়ায়েজী (বক্তব্যদানকারী) আলিমের উন্নতমানের পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান করা উচিত।
ঈদের দিন প্রত্যেক মুসলমানের ভাল কাপড় পরিধান করা ও সুগন্ধি ইত্যাদি লাগানো সুন্নাত; কারন যাতে, তার সাথে আলিংগন করতে লোক আগ্রহান্বিত হয়। এতে বোঝা গেল, যার সাথে সাধারণ মুসলমানদের সম্পর্ক, তার উচিৎ পরিপাটি অবস্থায় থাকা। আওলিয়া কিরামের মাযারসমূহে আল্লাহর বান্দাদের যিয়ারতের স্থান। তাই ওগুলোকেও পরিপাটি অবস্থায় রাখা বাঞ্চনীয়।

❖ হাকিমুল উম্মত শাইখুল হাদিস সাহেবে মিরআত শারহুল মিশকাত আল্লামা মুফতি আহমদ ইয়ার খান নাইমি র. বলেন : আমি নজদী-ওহাবীদের আমলে হজ্ব করতে গিয়েছিলাম।
সেখানে গিয়ে দেখি কাবা শরীফের চারিদিকে বৃত্তাকার অনেক বিজলী বাতি জ্বলছে এবং হাতিম শরীফের দেয়ালেও আলো ছিল। ঠিক কাবা শরীফের দরজার সামনে চার চারটি আলোকবর্তিকা জ্বালানো হতো। যখন মদিনা শরীফে এলাম সেখানে রওযা পাককে কাবা শরীফ থেকেও আলোকোজ্জল দেখলাম। ওখানকার বাল্বগুলো খুবই প্রখর ও উজ্জল ছিল। মানুষের অন্তরে শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি ও মহত্ব প্রকাশ করার জন্যই এর আয়োজন। আওলিয়া কিরামের মাযারসমূহেও অনরূপ আলোর ব্যবস্থা করলে ক্ষতি কিছু নেই।
আজকাল বিয়ে শাদী উপলক্ষে বাড়ীঘর আলোকসজ্জিত করা হয়ে থাকে। অনেক সময় আলোর প্রদীপও জ্বালানো হয়, যার জন্য অনেক তৈল লাগে।
মাদ্রাসার সভায় আলোকসজ্জা খাতে অনেক টাকা খরচ হয়। মাত্র কয়েক বছর আগের কথা, দেওবন্দীরা মুরাদাবাদে জমিয়তে উলামার এক সম্মেলনের আয়োজন করেছিল, যেখানে চোখ ঝলসানো বিজলী বাতি লাগানো হয়েছিল।
আমার মনে হয় কমপক্ষে দেড়শ টাকা (তৎকালীন) বিজলীর জন্য খরচ হয়েছিল।
এটা কেবল সমবেত জনতাকে খুশি করার জন্যই করা হয়েছিল। অনুরূপ ধর্মীয় সভা-সমিতিতে রংবেরংয়ের দ্বারা পতাকা দ্বারা সজ্জিত করা হয় এবং ওয়ায়েজীনের গলায় ফুলের মালা দেয়া হয়। এগুলোকে অপব্যয় বলা হয় না, না হারাম আখ্যা দেয়া যায়। তাই উরসের সমাবেশ যেহেতু ধর্মীয় সমাবেশ, সেহেতু তথায়ও এসব কাজ জায়েয।
📘 গ্রন্থ সূত্র :
*_* জা'আল হক্ব, ২য় খণ্ড।

ওরছ কি?....
   
ওরছ বুযুর্গানে দ্বীন, অর্থাৎ পীর-মুর্শিদগণের সালানা ফাতেহার অনুষ্ঠান,যে তারিখে তারা ইন্তেকালপ্রাপ্ত হন।উর্দু-ফার্সি অভিধান ‘ফিরোজুল্লুগাতে’ওরছ শব্দের হাকিকী ও মাজাজী অর্থের বর্ণনায় লেখা হয়েছে :‘ওরছ বুযুর্গ ইয়া মুর্শিদিকী ছালানা
ফাতেহাকী মজলিশ জুতারিখী ওফাতকো ছাদিকী দাওয়াত ত্বয়ামেওলীমা জামে আরসু’ (‘ফিরোজুল্লুগাত’)
অর্থাৎ, ওরছ-অর্থ : (১) কোন বুযুর্গ অথবা পীর-মুর্শিদের ইন্তেকালে সালানার তারিখ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত ফাতেহাখানির
অনুষ্ঠান। (২) বিবাহের দাওয়াত, ওলিমার খানা, বহুবচন আ’রুসু।Anniversary in memory of a saint. অর্থাৎ,
কোন সুফি-সাধকের ইন্তেকাল বার্ষিকীর স্মরণে আয়োজিত ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে ওরছ বলে। বাংলা একাডেমি
থেকে প্রকাশিত ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে’ ওরছ শব্দের নিম্নোক্ত অর্থ লেখা আছে, অলি-দরবেশদের
বেছালাতে তাঁদের সমাধিস্থলে পবিত্র অনুষ্ঠান বিশেষ।‘নাম কানাউমাতিল উরুসিল্লাতি লা-
ইউকিজুহু ইল্লা আহাব্বু আহলিহি এলাইহি’অর্থাৎ (কবরে নেক্কার ছালেহীন ব্যক্তিকে বলা হয়) তুমি এখানে
বাসরঘরের দুলহার মতো পরমানন্দে ঘুমাতে থাক, যার ঘুম তার পরিবারের
সর্বাধিক প্রিয়জন ব্যতীত অন্য আর কেউ ভাঙতে পারে না। (তিরমিজী শরীফ ও
মেশকাত শরীফ, ১ম খ- ৯৭ পৃঃ দ্রঃ),ইশবাতি আযাবুল কবর অধ্যায়।ওই হাদিস শরীফের মিছদাক হিসাবে ওরছ
শব্দকে মানবকূলে শরয়ী বলে গ্রহণ করাযায়। হাদিস শরীফে উল্লেখিত এই ওরছ শব্দের গুরুত্ব ও তাৎপর্য গ্রহণ করেই সুফিগণ আল্লাহর অলিগণের ইন্তেকাল দিবসকে
ইয়াউমুল ওরছ বা ওরছ শরীফ নামকরণ
করেছেন। কারণ ইন্তেকালের এই দিনে
মিলনাকাক্সক্ষী আল্লাহর অলিগণ
মাহবুবে হাকিকী অর্থাৎ, প্রকৃত বন্ধুর
একান্ত দীদার লাভ করে আকাক্সিক্ষত
মিলনের পরমানন্দে বিভোর হয়ে যান।
হাদিস শরীফে আল্লাহর অলিগণের পরম
সুখকর এই আত্মিক অবস্থাকে আপেক্ষিক
অর্থে বাসরঘরের দুলহার সঙ্গে পরম
প্রশান্তিময় সুখনিদ্রার তুলনা করা হয়েছে।
আরও বলা হয়েছে, যে সুখনিদ্রা হতে
তাকে শুধু তার প্রিয়তমই জাগাতে পারে,
অন্য কেউ নয়। এখানে সুখনিদ্রা
বোঝাতে পবিত্র আত্মাসমূহের
পারলৌকিক চির পরিতৃপ্ত জীবনের কথা
বলা হয়েছে, যা ভঙ্গ করার অধিকার অন্য
কারো নাই।
সুবিখ্যাত ‘জা’আল হক’ কিতাবের দ্বিতীয়
খ- ১৪৪ পৃষ্ঠায় ওরছ শব্দের উৎপত্তি এই
মানকূলে শরয়ীর ব্যাখ্যায় লিখেছেন- উ-
রুছের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে শাদী। এ
জন্যই বর-কনেকে আরবি ভাষায় ওরছ বলা
হয়। বুযুর্গানে দ্বীনের ইন্তেকাল
দিবসকে এজন্যই ওরছ বলা হয় যে, মিশকাত
শরীফে ‘ইশবাতি আযাবুল কবরী’ শীর্ষক
অধ্যায়ে বর্ণিত আছে, যখন মুনকার-নাকির
মাইয়্যাতের পরীক্ষা নেয় এবং যখন সে
সেই পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়, তখন তাকে
বলেনÑ ‘নাম কানাউমাতিল উরুসিল্লাতি
লা-ইউকিজুহু ইল্লা আহাব্বু আহলিহি
এলাইহি।’ আপনি সেই কনের মত শুয়ে পড়–
ন, যাকে তার প্রিয়জন ছাড়া আর কেউ
জাগাতে পারে না।
তাই মুনকার-নাকির ফিরিশতাদ্বয় যেহেতু
ঐ দিনকে উ-রুস বলেন, সেহেতু ওরছ বলা
হয়। অথবা এজন্য যে, ঐ দিন জামালে
মুস্তফা (স.) কে দেখার দিন। মুনকার-
নাকির হুযুর (স.) কে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা
করবেন, ওনার সম্পর্কে আপনার কী
ধারণা? তিনিই তো সৃষ্টি জগতের দুলহা,
সারাজগৎ তারই স্পর্শের প্রতিফলন। মহান
আল্লাহতায়া’লার সেই বন্ধুর সঙ্গে
সাক্ষাতের দিন নিশ্চয়ই ওরছের দিন।
এজন্য এই দিনকে ওরছ বলা হয়। (আস্তা
মাআ’মান আহব্বাবতা।) অর্থাৎ, তুমি
যাহাকে ভালোবাস আখিরাতে তুমি
তাহারই সঙ্গে থাকিবে। হাদিস শরীফের
এই সূত্র অনুযায়ী আল্লাহর অলিগণ যখন নশ্বর
ভুবন ছেড়ে অবিনশ্বর ভুবনে গমন করেন,
তখন তা মাহবুবে হাকিকী অর্থাৎ, প্রকৃত
বন্ধুর সঙ্গে চিরায়ত মিলনকক্ষে মিলিত
হন। হাদিস শরীফে প্রেমাষ্পদের দিকে
প্রেমিকের এই মিলনমুখী অভিযাত্রার
বিষয় বলা হয়েছে। ‘মৃত্যু সেতুতুল্য, বন্ধুকে
বন্ধুর সঙ্গে সম্মিলিত করিয়া দেয়”।
(মকতুবাত শরীফ, ১ম খ-, ১ম পৃষ্ঠা দ্রঃ)।
উল্লিখিত হাদিসসমূহে এবং আয়াতি
কারিমায় আল্লাহর অলিদের
ইন্তেকালের দিনকে পরম বন্ধুর সঙ্গে
তাদের মিলনের দিন বলে উল্লেখ করে
বলা হয়েছে, তাদের জন্য ইন্তেকালের
দিনটি হয় পরম সান্ত¡নার, পরম তৃপ্তির এবং
পরম সুখের।মেছবাহুল লোগাতে ‘ওরছ
শব্দের হাকিকী অর্থকে আনন্দে বা
খুশিতে আল্লাহতায়া’লার সঙ্গে
মহামিলন বলা হয়েছে। সুতরাং আউলিয়া-
কেরামের ইন্তেকালের দিনকে
‘ইয়াউমুল ওরছ’ বা ‘ওরছ শরীফ’ নামকরণ করার
সঙ্গে পবিত্র কোরআন, হাদিস এবং
আভিধানিক (হাকিকী ও মাজাজী)
অর্থের কোথাও কোন অসামঞ্জস্য বা
বিরোধ নাই।
‘ওরছ শরীফ’ নামকরণের হাদিসানুগ অন্য
একটি ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে,
আউলিয়া কেরামের আরওয়াহপাকের
হুজুরে ছোওয়াব রেছানী বা
ফাতেহাখানির অনুষ্ঠানকে এজন্যই সুফিগণ
ওরছ শরীফ নামকরণ করেছেন যে, বিভিন্ন
হাদিস শরীফের বর্ণনায় ইছালে ছওয়াব
বা ছওয়াব রেছানীর অনুষ্ঠানকে আত্মার
জন্য পরম খুশির বা আনন্দদায়ক বলা হয়েছে।
যেমন, হাদিস শরীফে উল্লেখ আছে:
আত্মীয়ের নিকট হইতে উপহার স্বরুপ কোন
দান বা দোয়া যখন কোন ইন্তেকালপ্রাপ্ত
ব্যক্তির রুহে পৌঁছে, তখন সে এরুপ
আনন্দিত হয় যেমন জীবিত ব্যক্তি উপহার
পেয়ে আনন্দিত হয়ে থাকে। (এহ্য়া উল
উলুম দ্রষ্টব্য)। বায়হাকী শরীফে বর্ণিত
অনুরূপ একটি হাদিসে বলা হয়েছেÑ ‘নাম
কানাউমাতিল উরসীললাতি লা-
ইউক্বিজাহু ইল্লা আহাব্বু আহলিহি
ইলাইহি।’ অর্থাৎ- ‘অতপর কবরবাসী ব্যক্তি
তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি অথবা
বন্ধু-বান্ধবদের নিকট হইতে দোয়া কামনা
করে। তদাবস্থায় যদি কেহ তার জন্য
দোয়া করে, তবে সে এত অধিক খুশি হয়
যে, জীবিতাবস্থায় সমস্ত দুনিয়া উপহার
হিসাবে পাইলেও সে এতো খুশি হইত না।
যেহেতু ওরছ শব্দের আভিধানিক এক অর্থ
খুশি বা আনন্দ, (মেছবাহুল লোগাত দ্রষ্টব্য)
সেহেতু আত্মার জন্য আনন্দদায়ক ছোয়াব-
রেছানীর এই অনুষ্ঠানকে ‘ওরছ’ নামকরণ
করার মধ্যে কোন ভ্রান্তি বা অসামঞ্জস্য
নাই। আমরা আহলে সুন্নাত যখন আল্লাহর
অলির নামে ওরছ অনুষ্ঠান করে থাকি, তখন
আল্লাহর অলিরা ছোয়াব-নজর পেয়ে খুবই
খুশি হন এবং দোয়া করে থাকেন। এই
আত্মিক খুশি বা সন্তুষ্টির কারণে, আহলে
সুন্নাত এই মহান ছোয়াব-রেছানীর
অনুষ্ঠানের নাম ওরছ রেখেছেন। ওরছ
আহলে সুন্নাতের এছ্তেলাহ্ বা খাস
ভাষা।

কেউ ইন্তিকাল করিলে তারজন্য কুলখানী ও ও জিয়াফতের দলিল বুখারি শরিফ হতে

দলিল: বুখারি শরীফ ১ম খন্ড পৃ: ৫৩৯, ২য় ও ৩য় লাইনে দেখুন আম্মাজান খাদিজাতুল কুবরা সালামুল্লাহি আলাইহা এর ইনতিকালের পর নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম) তাকে বেশি বেশি স্বরণ করেছেন এবং ছাগল জবাই করে বন্টন করে আত্নীয় স্বজনকে খাইয়েছেন। এতে শিরনী, ফাতিহা, কুলখানি, চেহলাম/চল্লিশা ও ইসালে সাওয়াব, মৃত ব্যক্তিকে স্বরণ করা সবকিছু ১০০% জায়েজ জায়েজ এবং জায়েজ,,,,,,,

তারপরও কিছু বেঈমান ঈমানচোর সাধারন মানুষের মাঝে ফেতনা ছড়ায় নতুন ফতুয়া বাজি করে।
____________________
হযরত নাফে’ (رحمة الله) বলেন,
“আমি হযরত (আবদুল্লাহ) ইবনে উমর (رضي الله عنه)-কে দেখেছি এক’শ বার বা তারও বেশি সময় মহানবী (ﷺ)-এর পবিত্র রওযা শরীফ যেয়ারত করেছেন।
 তিনি সেখানে বলতেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক; আল্লাহতা’লা তাঁকে আশীর্বাদধন্য করুন এবং সুখ-শান্তি দিন। 

হযরত আবূ বকর (رضي الله عنه)-এর প্রতিও শান্তি বর্ষিত হোক।’ অতঃপর তিনি প্রস্থান করতেন। হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه)-কে রওযা মোবারক হাতে স্পর্শ করে ওই হাত মুখে (বরকত আদায় তথা আশীর্বাদ লাভের উদ্দেশ্যে) মুছতেও দেখা গিয়েছে।” 

[ইমাম কাজী আয়ায (رحمة الله) কৃত ‘শেফা শরীফ’ গ্রন্থের ৯ম অনুচ্ছেদে বর্ণিত]

হযরত দাউদ ইবনে আবি সালেহ হতে বর্ণিত; তিনি বলেন: “একদিন মারওয়ান (মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের রওযা মোবারকে) এসে দেখে, এক ব্যক্তি রওযা শরীফের খুব কাছাকাছি মুখ রেখে মাটিতে শুয়ে আছেন। 

মারওয়ান তাঁকে বলে, ‘জানো তুমি কী করছো?’ সে তাঁর দিকে এগিয়ে গেলে সাহাবী হযরত খালেদ বিন যাঈদ আবূ আইয়ুব আল-আনসারী (رحمة الله)-কে দেখতে পায়। 

তিনি (সাহাবী) জবাবে বলেন, ‘হ্যাঁ (আমি জানি); আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে (দর্শনার্থী হতে) এসেছি, কোনো পাথরের কাছে আসি নি। আমি মহানবী (ﷺ)-এর কাছে শুনেছি, (ধর্মের) অভিভাবক যোগ্য হলে ধর্মের ব্যাপারে কাঁদতে না; তবে হ্যাঁ, অভিভাবক অযোগ্য হলে ধর্মের ব্যাপারে কেঁদো।”

রেফারেন্স/সূত্র

* আল-হাকিম এই বর্ণনাকে সহীহ বলেছেন; অপরদিকে, আয্ যাহাবীও তাঁর সত্যায়নের সাথে একমত হয়েছেন। [হাকিম, আল-মোস্তাদরাক, ৪র্থ খণ্ড, হাদীস নং ৫১৫]

* ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله)-ও তাঁর ’মুসনাদ’ গ্রন্থের ৫ম খণ্ডে সহীহ সনদে এটি বর্ণনা করেন। [হাদিস নং ৪২২]


Comments

Popular posts from this blog

ছেমা ই দালালাত

ইউসুফে ছানি গাউছুল আজম ছৈয়দ গোলামুর রহমান বাবাজান কেবলা রহঃ জীবনী দর্পণ।

কোরআন সুন্নার আলোকে পীর ও মুরিদ।