হযরত মাওলানা আমিনুল হক হারবাংগিরি (ক.) জীবন দর্শন

 হযরত মাওলানা আমিনুল হক হারবাংগিরি (ক.)    জীবন দর্শন। 


যরত আমিনুল হক হারবাংগিরি (ক.)-এর জন্মস্থান বার্মার মেও মেও নামক স্থানে। আজ থেকে বহু আগে জীবনের কোন এক সময়ে সঠিক পীরের তালাশে তিনি বার্মা হতে টেকনাফ কক্সবাজার হয়ে বাঁশখালীর হারবাং নামক জায়গায় আসেন। সেখানে কিছুদিন অবস্থানের পর চট্টগ্রাম শহরের পথে রওয়ানা হয়ে এক সময় চট্টগ্রাম শহরের নাজিরহাট রােডের আমান বাজার নামক স্থানে খােশাল শাহ মসজিদে নামাজ আদায় করেন। মাগরিব কিংবা এশারের নামাজ হবে। নামাজ আদায় করতঃ মসজিদের ইমাম সাহেবের সাক্ষাতের অপেক্ষায় মসজিদে কিছু সময় বসে থাকলেন। এক একে সব মুসল্লি চলে গেলেন। বাকি থাকলাে ইমাম সাহেব আর সাক্ষাতপ্রার্থী। সাক্ষাতপ্রার্থী মনে মনে খুশী হলেন। যে ইমামের পিছনে নামাজ পড়লাম, নামাজে তাে খুবই মজা পেলাম। কত সুন্দর নামাজ। মনে হয়, এমন নামাজ জীবনে পড়িনি। মনে হয়, আমি আমার সঠিক গন্তব্যে পৌঁছেছি। এ ধরনের আলেমে দ্বীনের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করলেই আমার মনজিলে মকসুদে পৌঁছতে পারবাে। মুসাফির মনে মনে খুবই খুশি। মসজিদেও কেউ নেই। আমি আর ইমাম সাহেব ব্যতীত। এখনই মােক্ষম সুযােগ। আমি হুজুরের নিকট মনের কথা খুলে বলি। যথা সময়ে ইমাম সাহেব নামাজের পর নিজ তরিকার তসবীহ ও মুরাকাবা কার্য সমাধাকরত বাইরের দিকে রওয়ানা দেবেন এমনি আগন্তুক হুজুরের কদমে সালাম নিবেদন করে নিজের মনের কথা প্রকাশ করলেন।

হুজুর আগন্তুকের সকল কথা মনােযােগসহকারে শুনলেন। মৃদু হেসে জানালেন, বৎস! তুমি যে ধরনের মুরশিদের তালাশ করছ সেই ধরনের একজন বুজুর্গ আলেমের খবর তােমাকে দিতে পারব। আমি তােমাকে বাইয়াত করাতে পারব না। আগন্তুক যখন তার মনের আশা মত বাইয়াতের সুযােগ পেল না, চিন্তা করল ইনি যেহেতু একজন বুজুর্গ আলেম। ওনার দিক নির্দেশনা হাতছাড়া না করে গ্রহণ করা ভাল। একজন বুজুর্গ আলেম নিশ্চয় আমাকে আরাে ভাল মুরশিদের পথ দেখাতে সক্ষম। কবির ভাষায়

“মুরশিদ পথ দেখাইয়া দাও সেই পথ আমি চিনি নাগাে সঙ্গে কইরা নাও”

মুরশিদ পথ দেখাইয়া দাও।”

তখন আগন্তুক হুজুরের নির্দেশিত পীরের নিকট যাওয়ার মনস্থ করতঃ কিভাবে যাবেন তার ঠিকানা ইত্যাদি জানার জন্য আরজি পেশ করলেন। হুজুরের দয়া হয়। তাকে বললেন, “বৎস! রাঙ্গুনিয়া। মাইল্লা টিলা নামক স্থানে একজন বুজুর্গ আলেম আছে। তুমি তার নিকট গিয়ে বাইয়াত হও; আমি দোয়া করি। ইনশাআল্লাহ সফল। হবে।” অতপর আগন্তুক বার্মা থেকে এখানে নতুন দেশে নতুন জায়গায় এলেন। কত কষ্ট, নাই গাড়ি, নাইকি। ওও তিনি পিছপা হতে চাননা। সংকল্প করলেন যত ঝড়-ঝাপটা তাগুত মনজিলে মকসুদে পৌঁছতেই হবে। শত কষ্ট-দুঃখ তাকে দমাতে পারেনি। | সত্য তালাশ প্রার্থীদের কেউ দমাতে পারে না। তারা শুহত্য একদিন পাবে। তাই কবির ভাষায় বলা যায়-

“তােমার নামে দিলাম ছাড়ি ভাঙ্গা ছফিনা,

পার কর ডুবাইয়া মার, তােমার মহিমা ?”

অতপর রাঙ্গুনিয়া মাইল্লা টিলাতে গিয়ে উপিস্থত। সালাম ও কুশল বিনিময়ের পর আগন্তুক খােশাল শাহ মসজিদের ইমাম কর্তৃক তাকে এখানে প্রেরণের কথা জানিয়ে নিজের মনের কথা ব্যাক্ত করলেন। আগন্তুকের সব কথা মনােযােগসহকারে শুনলেন। অতপর হুজুর আগম্ভককে বললেন, আমি আপনাকে মুরিদ করতে পারব। ফটিকছড়ির ইছাপুর মাইজভাণ্ডার শরীফে একজন মাওলানা । আছেন। আপনি বরং তার কাছে যান। উনি আপনার সঠিক পীর। আপনি ওনার নিকট গিয়ে বাইয়াত গ্রহণ করেন। উনিই জমানার। বড় হস্তি। উনিই আপনার অন্ধকার জীবনে আলাের দিশারী।

তা শুনে আগন্তুক মাওলানা আমিনুল হক হারবাংগিরি (রা)। আশাহত হলেন না। সত্য প্রত্যাশী মানুষকে দীর্ঘ পথের ক্লান্তি দমাতে পারেনা। হারবাংগিরি মাওলানাও পিছপা হবার মানুষ নন। যত বাধা। আসুক যত ক্লান্তি দুঃখ মাথা পেতে নিয়ে ছুটেছেন ফটিকছড়ির বড় মওলানার আস্তানায়। পথ চলতে চলতে একদিন গিয়ে ফটিকছড়ির বড় মওলানার আস্তানায় উপস্থিত। দেখতে পেলেন আস্তানা শরীফে। নূরানী সিংহাসনে যেই মওলানা সাহেব উপস্থিত, তিনিই খােশাল শাহ মসজিদের ইমাম। তিনিই রাঙ্গুনিয়া মাইল্লা টিলার হুজুর। প্রার্থিত হুজুর কবেলা.। একই ব্যক্তি তিন জায়গায়। কী আশ্চর্য! মওলা করিম বকসের ভাষায় :

“আরবে আহমদ বলে,

মিশরে মাশুক বলে,

মাইজভাণ্ডারে দেখিরে ভা

খােদার কারখানা।”

অতপর আশেক মাশুকের দিদারে মন শান্ত হয়। খােদার দরবারে শুকরিয়া আদায় করেন তিনি। নিজের মনজিলে মকসুদে  পৌঁছুতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করেন এবং হযরতের কদমে সালাম আবজি পেশ করে নিজেকে সােপর্দ করে নিজের আউয়াল আখের জাহের বাতেন মুরশিদ হিসাবে গ্রহণ করেন। অতপর বাবাজান এই সত্য প্রত্যাশী বান্দাকে নিজের মুরিদ বা শিষ্য হিসাবে গ্রহণ করে নিজের কদমে স্থান দেন এবং বাবাজান তাকে দয়া করেন। কবির ভাষায় –

“তুমি যারে করেছ দয়া দয়ালরে /কৃপা দান ক্ষমা করাে আমারে”।

অতপর হযরত সৈয়দ শাহ আহমদ উল্লাহ্ মাইজভাণ্ডারী (ক.) মওলানা আমিনুল হক হারবাংগিরিকে নির্দেশ দিলেন, বৎস! তুমি ছায়ের (ভ্রমণ) কর। অতপর নির্দেশ হল, বৎস!তুমি এখান থেকে সােজা দক্ষিণ দিকে চলে যাবে। যেখানে তােমার মাগরিবের নামাজের সময় হবে, সেখানে নামাজ। আদায় করবে এবং সেখানেই তুমি থাকবে। সেখানেই তােমার বাড়ি ঘর। সেখানেই তােমার বসত বাড়ি। আপন মুরশিদের আদেশ পাওয়ার পর মওলানা হারবাংগিরি এক মুহূর্ত দেরি করে মুরশিদের নির্দেশিত গন্তব্যে রওয়ানা হলেন। অচেনা পথ। এদেশের রাস্তা ঘাট কিছু তার জানা নেই। তারপরও মুর্শিদের নির্দেশ পালনে আল্লাহর ওপর ভরসা করে যেতে যেতে কাইছা খাল(কর্ণফুলী নদী) নামক এক জায়গায় গেলে মাগরিবের নামাজের সময় হয়। সেখানে এক মসজিদে প্রবেশ করে মাগরিবের নামাজ আদায় করেন (বর্তমানে বােয়ালখালীর চরণদ্বীপ)। নামাজ শেষে কিছুটা চিন্তামনস্ক হলেন। মহান মুরশিদের নির্দেশনা মোতাবেক অতটুকু এসে পৌঁছলাম। এখানে নেই কোন আপনজন, নেই কোন জানা শােনা লােক। কিভাবে কি করবাে মনের ভিতরে বিভিন্ন চিন্তা। এমনি সময় পিছনে একজন লােক সালাম দিয়ে জানালেন হযরত গাউসুল আজম মুরশিদ কেবলা আমাকে পাঠিয়েছেন এই বলে যে, আপনাকে যেখানেই পাই সেখানেই আপনার ঘর বাড়ি, সেখানেই আপনি থাকবেন। আর কোথাও যেন না যাই। তার জন্য হুজুরের কড়া নির্দেশ। মাওলানা হারবাংগিরি সাহেব বুঝতে পারলেন নিশ্চয় মনিব নির্দেশ দিয়েছেন, দয়া করেছেন। এর মাঝে নিশ্চয়ই কোন হেকমত বা রহস্য আছে। তারপরও ঐ লােককে বললেন, এটাতাে —- দ্বীপ। আমি কি এখানে থাকব? লােকটার উত্তর, হঁ্যা এখানে থাকার নির্দেশ হয়েছে। মহান মুরশিদের নির্দেশে আপনাকে এখানেই থাকতে হবে। হযরত হারবাংগিরির উসিলায় আজকের —- দ্বীপ হয়ে গেল চরণদ্বীপ। হারবাংগিরি সাহেবের স্পর্শধন্য সেই এলাকা আজ আবাদ হয়ে গেল। ছােবহানাল্লাহ-এই হচ্ছে আল্লাহর অলিদের শান। অতপর হযরত কেবলা দয়ার বরকতে সেখানে তিনি বসতি স্থাপন করলেন। ঘর বাড়ী হল। একটি পুত্র সন্তান হল। নাম তার হযরত মওলানা রাহমাত কবির মিঞা হারবাংগিরি।

কথিত আছে যে, তিনি ওনার ভক্তদের নিয়ে নৌকায় করে হালদা খাল হয়ে নাজিরহাট বাজারে আসতেন। নাজিরহাট হতে পায়ে হেঁটে হযরতের দরবারে যেতেন। দরবারে আসা-যাওয়ার মধ্যে হযরতের আরেক মুরিদ হাসমত ফকিরের সাথে পরিচয়। পরিচয় সূত্রে বন্ধুত্ব। বন্ধুত্বের সূত্রে দুই বন্ধু আরাে ঘনিষ্ঠ হলেন। হাসমত ফকির বন্ধু আমিনুল হককে তার বাড়িতে বেড়াতে আসতে দাওয়াত করলেন। হাসমত ফকিরের বাড়ি মাইজভাণ্ডার শরীফ থেকে দক্ষিণ দিকে দুই থেকে আড়াই মাইল ব্যবধানে ছাদেক নগর খলিফার বাড়ি। মওলানা হারবাংগিরি হুজুর একদিন হাসমত ফকিরের বাড়িতে তার ভক্তদের নিয়ে যথাসময়ে হাজির। এসে অনুভব করলেন হাসমত ফকির তেমন অবস্থাসম্পন্ন নয়। বাড়িতে জায়গাও বেশী সংকুলান হওয়ার নয়। তিনি চিন্তা করে হাসমত ফকিরকে বললেন, ভাই! তােমার এখানে আমার লােকজন সংকুলান দিতে পারবে না। যদি পার, তােমার এলাকায় একজন জমিদার শ্রেণীর লােক থাকলে তাদের সাথে কথা বলে দেখ, রাজী হয় কিনা। কারণ মাওলানা হারবাংগিরি প্রতি বৎসর মাইজভাণ্ডার শরীফে তার ভক্তবৃন্দসহ নিয়ে যেতেন।

আস্তানা শরীফের সম্মুখভাগ

বােয়ালখালীর চরণদ্বীপ থেকে তিনি মহান মুরশিদের দরবারে ভক্তবৃন্দ নিয়ে পায়ে হেঁটে আসতেন। দূরের পথ বিধায় অনেক রাত হয়ে যেত। তাই পথিমধ্যে কোথাও রাতে বিশ্রামের দরকার হতাে। তা উপলব্ধি করে মাইজভাণ্ডারের নিকটে কোথাও বিশ্রামের জন্য বা আস্তানা শরীফের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেন। হাসমত ফকির রাজা মিঞা চৌধুরীর আব্বাজান আব্দুল আজিজ চৌধুরীকে প্রস্তবটি পেশ করলে তিনি সাদরে গ্রহণ করলেন। প্রকাশ থাকে যে, ছাদেক নগরে মরহুম আব্দুল আজিজ চৌধুরী সম্ভ্রান্ত বংশের ও ধনী লােক ছিলেন। তাদের বাড়ির পূর্বনাম চট্টগ্রামের ভাষায় ‘মুলুইরু বাড়ি’ মানে `মাওলানার বাড়ি’ প্রকাশ ছাদেক আলী মাওলানার বাড়ি। এই ছাদেক আলী মাওলানার নামে নাকি `ছাদেক নগর’ গ্রামের নামকরণ হয়। বংশানুক্রমে ছাদেক আলী মাওলানা ও মরহুম আব্দুল আজিজ চৌধুরী একই বংশের। মরহুম আব্দুল আজিজ চৌধুরী সম্মানিত লােক ছিলেন। তার ছেলেদের মধ্যে মরহুম রাজা মিঞা চৌধুরী ও মরহুম হেদায়েত আলী চৌধুরীও এলাকায় সম্মানিত। ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। পরবর্তীতে তাদের বাড়ির নাম রাজা মিঞা চৌধুরী বাড়ি হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। মরহুম রাজা মিঞা চৌধুরীর এক ছেলের নাম কবির আহমদ চৌধুরী। তার বড় ছেলের নাম হযরত ফরিদ আহমদ চৌধুরী। তিনি তার ফুফা হযরত মাওলানা রাহমাত কবির মিঞা হারবাংগিরির ফয়েজপ্রাপ্ত। জনাব হাসমত ফকিরের প্রচেষ্টায় ও সহযােগিতায় হারবাংগিরি সাহেব আব্দুল আজিজ চৌধুরীর বাড়িতে রীতিমত আসা-যাওয়া শুরু করলেন। সেখানে আসা-যাওয়া হতাে। বিশেষভাবে ১০ মাঘ ওরশ শরীফের আগের দিন রাতে পৌঁছতেন। আসা-যাওয়ার মাধ্যমে এখানে মাওলানা আমিনুল হারবাংগিরির (ক..) অনেক কারামত প্রকাশ হয়ে গেল।

আশ্রয়দাতারাও অনেকটা ওনার প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধায় খেদমতে নিয়ােজিত হলেন। প্রতি বৎসর নির্দিষ্ট সময় ও তারিখে যখন হযরত মাওলানা হারবাংগিরি (ক.) রীতিমত আসা-যাওয়া শুরু করলেন তখন প্রতি বৎসর আস্তে আস্তে সেখানেও একটি আসরে পরিণত হতে লাগলাে। বিশেষ করে অনেক মজজুব ফকির ও দরবারী ভক্তবৃন্দের আসরে উনার বহু সময়ে বহু কারামত ও গুপ্ত রহস্য প্রকাশিত হয়। একবার হযরত মাওলানা হারবাংগিরি সাহেব (ক.) চৌধুরী বাড়িতে উপস্থিত। ঘটনাক্রমে সেখানে কারাে মৃত্যু হয়। তাই জানাজা উপলক্ষে অনেক স্থানীয় আলেম ওলামা নামাজে উপস্থিত হন। জানাজা শেষে তারা জানতে পারেন যে, চৌধুরী বাড়িতে মাওলানা আমিনুল হক হারবাংগিরি সাহেব আছেন। তারা দল বেঁধে জনাব হারবাংগিরি সাহেবকে কিছু প্রশ্ন করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তারা কিছুটা ভীতও ছিলেন। তাই তারা রাজা মিঞা চৌধুরীকে তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানায়। চৌধুরী সাহেবের মেহমান বিধায় উনার মাধ্যমে প্রশ্ন করতে পারলে হয়ত কোন বিপদের সম্ভাবনা থাকবেনা। এলাকাটা সুন্নি অধ্যুষিত বিধায় আলেমদের মাঝেও সুন্নিপন্থীদের প্রাধান্য থাকলেও সেখানে ঢােল বাদ্য বাঁশি বাজনা ইত্যাদি আলেম সমাজে প্রচলিত ছিল না। উল্লেখ্য যে, মাওলানা হারবাংগিরি সাহেব কেবলা নিজে বাঁশি বাজাতেন এবং দরবারে যাওয়ার সময়ে নাকি তিনি নেচে নেচে বাঁশি বাজাতেন। তাদের বাঁশির সুর ও বাঁশির ধরণ অন্য রকমের ছিল। ওনার বাঁশির সুরে আশেকরা আত্মহারা বিভাের হয়ে যেতেন। উনার গায়ের রং এত সুন্দর ছিল যে লােকে বলতেন, তিনি সােনা। অর্থাৎ স্বর্ণ খেতেন তাই গায়ের রং স্বর্ণের মত চিক চিক করতাে। আসলে তিনি হযরতের নূরের সাগরের সাঁতারু। হযরতের খলিফাদের অন্যতম। হযরত কেবলার বহু পরীক্ষিত বন্ধু। চরম বিপদেও মুরশিদের অবাধ্য হননি তিনি।

এই মহান অলিয়ে কামেল হযরতের রঙে রঙিন। উনার চক্ষু ছিল প্রসারিত। চুল মােবারক কিছুটা লম্বা ছিল। শারীরিক গড়ন লম্বা ও সৌম্য পুরুষ। রাজা মিয়া চৌধুরী সাহেবের মাধ্যমে তারা কিছু প্রশ্ন করার অনুমতি চাইলে হুজুর তাদেরকে সাদরে ভিতরে আসবার অনুমতি দিলেন এবং তাদের প্রশ্ন করার অভয় ও অনুমতি দিলেন। অতপর তারা হুজুরের নিকট প্রশ্ন করলেন-হুজুর! আপনি একজন এত বড় আলেমে দ্বীন। আপনি শরীয়তের বিরােধী ঢােল ও বাঁশি কেন বাজিয়ে থাকেন? এটাতাে কোনভাবে জায়েজ নেই। আপনি তাে আমাদের চেয়েও ভাল জানেন।

হারবাংগিরি সাহেব (ক.) তাদেরকে উত্তর দিলেন, বাবা আমি তােমাদের সাথে তর্কে যাবাে না। তবে এটা বলব যে, এদেশে মাত্র আধা চামচ ‘পন্না’ আছে আপনাদের। অর্থাৎ আপনারা সামান্য লেখাপড়া করেছেন। আল্লাহর ৯৯টি নাম আছে। আমি মাত্র এক নামে ডাকি। তাতে কারাে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এই বলে ওনার সহযােগিকে নাম ধরে বললেন, বাঁশি বাজাও এবং তিনি নিজেও বাঁশি বাজনা আরম্ভ করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে সকল আলেম প্রেমে বিভাের হয়ে কান্নাকাটি করতে লাগলেন। কেউ কেউ বাঁশি ও বাজনার সুরে এভাবে তন্ময় বিভাের ও বেঁহুশ হয়ে গেল। এই প্রেমের আসর কিছুক্ষণ পরে শেষ হলে আলেম সমাজ সকলে সম্মিলিতভাবে তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে বিদায় নিলেন। কেউ কেউ তাঁর ভক্তে পরিণত হয়ে গেল। এ জন্যই বলা হয়;

“এক জমানা ছােহবতে বা আউলিয়া /বেহতর আজ ছদ ছালে তায়াত বেরিয়া”।

ছােবহানাল্লাহ-এই হচ্ছে আল্লাহর অলির শান। আরেক দিনের ঘটনা- হারবাংগিরি হুজুর যখনই এখানে আসতেন, এলাকার ও দূরের অনেক ফকিরের আগমন হতাে। তাদের মধ্যে আজু ফকির নামে এক ফকির হুজুরের ভক্তও ছিল। তাই হুজুরকে দেখামাত্র কদমে লুটিয়ে পড়ে। ওনাকে হাঁটু বরাবর ধরে আলগিয়ে কাঁধের উপর নিতে চাইলে হারবাংগিরি হুজুর (ক.) খুবই রেগে গিয়ে তার মুখে-নাকে-চোখে হাত দিয়ে কিছুটা আঁচড় দিয়ে রক্ত বের করে ফেললেন এবং বললেন-বেয়াদব, এখন আমাকে আলগাও দেখি। |

আজু ফকির আবার চেষ্টা করলেন। দেখা গেল এক ইঞ্চি পরিমাণও মাটি থেকে উঠাতে পারলেন না হযরত হারবাংগিরি (রহ) কে।

মাওলানা হারবাংগিরি’র ঐতিহাসিক ছাতা, যা এখনো দরবারে দৃশ্যমান

এভাবে হারবাংগিরি হুজুর আসতে আসতে তাদের সাথে আত্মীয়ের মত হয়ে গেলেন। একদিনের ঘটনা। একদিন হারবাংগিরি সাহেবকে যেখানে আস্তানা শরীফ দেওয়া হয়েছে সেই কাচারি ঘরে একখানা চৌকি ছিল। সেখানে রাজা মিঞা চৌধুরীর ভাই হেদায়ত আলী চৌধুরী সাহেবকে যেখানে হুজুর থাকতেন সেই চৌকির সাথে বেঁধে রাখেন। উদ্দেশ্য, চৌধুরী সাহেবের মেয়েকে নাকি হারবাংগিরি সাহেব কেবলার ছেলে রাহমাত কবির মিঞার সাথে বিয়ে দিতে হবে। কেমন আবদার! যাদের বাড়িতে আশ্রিত তাদেরকে বেধে রাখা! কে বুঝিবে আউলিয়া কেরামের শান। শুভ বিবাহ হয়ে গেল। আত্মীয়তার সূত্রে তারা আবদ্ধ হয়ে গেলেন। আস্তানা শরীফের চৌকির সাথে বাধা নয় আউলিয়ায়ে কেরামের দলে অন্তর্ভুক্ত হলেন তারা। চৌধুরী বাড়ি এখন হয়ে গেল হারবাংগিরি হুজুরের বেয়াই বাড়ি। রাহমাত কবির মিঞা হুজুরের শ্বশুর বাড়ি। বর্তমান হারবাংগিরি দরবারের সাজ্জাদানশীন হযরত মাওলানা মােহাম্মদ মিঞা হুজুর কেবলার নানার বাড়ি। রাজা মিঞা চৌধুরী সাহেব হারবাংগিরি হুজুরের আসা যাওয়াকে খুবই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতেন। হুজুরের সাথে আসা মেহমানদের সাধ্যাতীত আপ্যায়ন খাতির করতেন। বাড়ির সবাই সহযােগিতা করতেন। মজজুব অলি ফরিদ আহমদ চৌধুরী তার বড় নাতি। তার নিকট দূর দূরান্ত থেকে বহু মানুষ বিভিন্ন হাজত মকসুদ নিয়ে আসেন। ওনি ঠিকভাবে লােকের সাথে কথা না বললেও অনেকের নাকি আশা পূর্ণ হয়। প্রতি বৎসর ২৮ পৌষ তার নির্দেশে রাজামিয়া চৌধুরী বাড়িতে বিশ্বের আউলিয়া কেরামের ওরশ শরীফ অনুষ্ঠিত হয়। তাছাড়া ছাদেকনগর রহমানিয়া স্কুলেও আউলিয়া কেরামের ওরশ শরীফ অনুষ্ঠিত হয়। ৯ মাঘ রাতে হারবাংগিরির আস্তানা শরীফকে স্মরণ করে বিশেষ অনুষ্ঠান, সেমা, কাউয়ালি মাহফিল ইত্যাদি অনুষ্ঠানাদি হয়। জনশ্রুতি আছে যে, হারবাংগিরি হুজুর নাকি বড় একটি ছাতা নিয়ে তাঁর বাড়ি বােয়ালখালীর চরণদ্বীপ থেকে ভক্তবৃন্দ নিয়ে ৯ মাঘ সকালে মাইজভাণ্ডার শরীফের উদ্দেশে রওয়ানা দিতেন। সাথে হাদিয়া গরু-মহিশ-ছাগল ইত্যাদিসহ পায়ে হেঁটে আসতেন। ঢােলের তালে তালে এক সময় দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে কিভাবে শেষ হতাে কেউ বলতে পারতােনা। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যেত। এক সময় চৌধুরী বাড়ি থেকে কিছু দূর দক্ষিণে ছাদেক নগর বাগিছা মসজিদের পাশে এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতেন। সেখানে চৌধুরী বাড়ির লােকজন হ্যাজাক বাতি নিয়ে হারবাংগিরি হুজুরকে আগ বাড়ায়ে নিতেন। চৌধুরী বাড়ির কাছে আসলে মাইকে নারায়ে তকবীরের আওয়াজ শােনা যেত।


–তথ্য সংগ্রহ, আলোকধারা থেকে। 

Comments

Popular posts from this blog

ছেমা ই দালালাত

ইউসুফে ছানি গাউছুল আজম ছৈয়দ গোলামুর রহমান বাবাজান কেবলা রহঃ জীবনী দর্পণ।

কোরআন সুন্নার আলোকে পীর ও মুরিদ।