ওয়াহ্দাতুল ওজুদ তত্ত্বের মূল দর্শন।
ওয়াহদাতুল অজুদের সঠিক অর্থ হল এই যে এই বিশ্ব আসল এবং পরিপূর্ণ অস্তিত্ব কেবলমাত্র মহান আল্লাহ তাআলারই।
দার্শনিক ও সুফী তত্ত্বদর্শি চিন্তার মূল বিষয় হলো ওয়াহ্দাতুল ওজুদ। ধর্মীয় দর্শনের ভাষায় ওয়াহ্দাতুল ওজুদ অর্থ সত্তার ঐক্য, ঐক্য নীতি, অদ্বৈতবাদ বা সর্বেশ্বরবাদ। ওয়াহ্দাতুল ওজুদ তত্ত্বের মূল কথা হলো সকল অস্তিত্বশীল সত্তার মূল সত্তা একই যাকে ধর্মীয় ভাষায় আমরা আল্লাহ বলি। আল্লাহ একমাত্র পরম সত্তা অর্থাৎ সব কিছুই আল্লাহ এবং আল্লাহই সব। সব কিছুই আল্লাহর অস্তিত্বেই অস্তিত্ববান। ওয়াহ্দাতুল ওজুদ তত্ত্ব অনুযায়ী এ বিশ্বজগত আল্লাহ-সত্তাময়, আল্লাহ্ ব্যতীত দ্বিতীয় কোন অস্তিত্ব নেই। হাদীসে কূদসীতে আল্লাহ বলেন, আমি গুপ্ত ভান্ডার ছিলাম। নিজেকে জানার (ও দেখার) জন্য সৃষ্টিকে প্রকাশ করলাম। এতে বুঝা যায় যে, এ বিশ্বজগত আল্লাহর নাম ও গুনের প্রকাশ এবং আল্লাহ্ ও বিশ্বজগত অভিন্ন অর্থাৎ আল্লাহ নিজেই প্রকাশিত হয়েছন বিশ্বজগত রূপে। আল্লাহ একমাত্র পরম সত্তা বা "ওয়াজেবুল ওজুদ" এবং বিশ্বজগত তাঁরই নাম ও গুনাবলীর প্রকাশ মাত্র। আল্লাহ আউয়াল আখের জাহের ও বাতেন - এ চারভাবেই বিদ্যমান। কাজেই আল্লাহ অনির্দিষ্ট আদি থেকে অনাদী ভবিষ্যৎ অবধি বিচিত্র প্রকাশ্য সৃষ্টি (ওয়াহ্দাতুল ওজুদ) ও অসিম গুপ্ত রহস্যরূপে (ওয়াহ্দাতুল হাকিকত) বিদ্যমান।
কোরআনে আল্লাহ পাক বলে গেলেন, যে রাসূলের হাতে হাত দেয় সে আল্লাহরই হাতে হাত দেয়, তাঁদের হাতের উপরেই আল্লাহর হাত।
রাসূল সাঃ বলে গেলেন, আমার মওলা আল্লাহ, আমি তোমাদের মওলা, আমি যার মওলা আলীও তার মওলা।
মুসলিম দর্শনে ওয়াহ্দাতুল ওজুদ সর্ব প্রথম প্রকাশ করেন হযরত বায়জিদ বোস্তামী রঃ। তিনি'' হামে উসত,,(সবই সে) বলে সর্বেশ্বরবাদের গোড়াপত্তন করেন। এরপর তাঁর সোবাহানী (মহিমা আমারই) ঘোষণা মুসলিম জাহানে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। তারপর ওয়াহ্দাতুল ওজুদ প্রকাশ করতে গিয়ে মনছুর হাল্লাজ বলেছিলেন, ''আনাল হক '' (আমিই সত্য) এবং একারণে তাঁকে ফাঁশিকাস্ঠে প্রান দিতে হয়েছিলো। এরপর হযরত ওমর ইবনুল ফরিদ রঃ বলেছিলেন, আনা হিয়া (আমিই তিনি)। এসব সূফী সাধকগন ওয়াহ্দাতুল ওজুদ অতি সংক্ষেপে প্রকাশ করলেও এর কোন দার্শনিক ব্যাখ্যা তাঁরা প্রদান করেন নি বলেই শরীয়তপন্থীগণের চাপের মুখে রাষ্টীয় প্রশাসন তাঁদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলো।
এরপর ইবনুল আরাবি তাঁর ফুসুসুল হিকাম ও ফতুহাতুল মক্কিয়া গ্রন্থে বিস্তারিত দার্শনিক ব্যাখা লিখেন। কিন্তু তাঁর ধারণা জ্ঞান মূলক ও ধর্মিও চেতনার মিশ্রণজাত তত্ত্ব হবার কারণে বুঝার জন্য অত্যন্ত কঠিন ও জটিল।
হযরত আবদুল কাদের মহীউদ্দীন জীলানী রঃ বলেন, আমার কদম সকল আওলিয়াদের কাধের উপর।
খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি সঞ্জরী রঃ বলেন, আমিই রুহে কূদসী, আমার থেকে সকল আত্মার সৃষ্টি।
তিনি ছাড়া সমস্ত কিছুর অস্তিত্ব ধ্বংসশীল এবং অসম্পুর্ণ। তার কারণ এটাই যে সেসবগুলি একদিন বিলুপ্ত অর্থাৎ ফানা হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত’ প্রত্যেক জিনিসই মহান আল্লাহ তাআলার মোহতাজ অর্থাৎ মুখাপেক্ষী। সুতরাং যত জিনিসপত্র আমরা দেখতে পায় যদিও তাদের অস্তিত্ব আছে কিন্তু মহান আল্লাহর অস্তিত্বের মুকাবিলায় তাদের কোন মুল্যই নেই। কেননা তারা ধ্বংসশীল। এর একটি উদাহরণ হল, যেরকম দিনের বেলায় আকাশে সুর্য থাকার জন্য অন্যান্য নক্ষত্র দেখা যায় না। যদিও তারা আকাশে আছে কিন্তু সুর্যের উপস্থিতি এবংভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়ে যে সেই নক্ষত্রগুলি দেখা যায় না। ঠিক সেইরকম যে ব্যাক্তিকে আল্লাহ তাআলা আসল পরচিতি দান করেছেন তিনি যখন সেই বিশ্বে আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বের সান্যিদ্ধ লাভ করে তখন তাঁর নিক্ট সমস্ত অস্তিত্ব মূল্যহীন হয়ে যায় যা হযরত মজজুব রহমাতুল্লাহ আলাইহি (শায়খ ইবনে আরাবী) বলেছেন।
‘যব মেহের নুমাইয়া হো আসর ছুপ গয়ে সিতারে
মাসআলা অয়াহদাতুল ওজুদ এর সংজ্ঞা বলার আগে জেনে রাখা উচিৎ যে ওয়াহদাতুল ওজুদ কোন আকিদা নয় এটা একধরনের মাসআলা। সেজন্য এই ওয়াহদাতুল ওজুদের ব্যাপারে আমাদের কোন আকিদার গ্রন্থে আলোচনা করা হয়নি। এর সম্পর্কে আমাদের মাসআলার গ্রন্থে আলোচনা করা হয়েছে। সেজন্য এটাকে আকিদা ওয়াহদাতুল ওজুদ না বলে মাসআলা ওয়াহদাতুল ওজুদ বলাই সঠিক।
তো মুঝকো ভরী বজম মে তনহা নযর আয়া।’
এটাই হল ওয়াহদাতুল ওজুদের পরিস্কার এবং সঠিক অর্থ। কিন্তু এর যা দার্শনিক অর্থ করা হয়েছেতা বড়ই ভয়ানক। আর এর মধ্যে যখন হুলুল চলে আসে তখন এই আকিদার সীমা কুফর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সেজন্য একজন মুসলমানের এইরকম পঋস্কার আকিদা রাখা উচিৎ যে ব্রহ্মান্ডে আসল এবং পরিপূর্ণ অস্তিত্ব কেবলমাত্র আল্লাহ তাআলারই। বাকি সমস্ত কিছুর অস্তিত্ব অসম্পূর্ণ এবং ধ্বংসশীল ।” (ফাতাওয়া উসমানী, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৬৬)
ওহাদাতুল ওজুদের তত্বটা প্রথম বলেছিলেন হুসেন ইবন আলী নাম এক ব্যক্তি | তিনি একটা বই লিখেছিলেন মিরাত উল আরিফিন | এই বইটা তার ছেলের প্রশ্নের উত্তরে তিনি লিখেছিলেন | প্রশ্নটা হলো সুরা আল ফাতিহার ব্যাখ্যা | এই বইতেই তিনি প্রথম ওহাদাতুল ওজুদের তত্বটা বিশদে লিখেছিলেন | এরপর অতিন্দ্রিযবাদী লেখক আবু সায়িদ মুবারক মাখজুমি তাঁর বই তোহফা মুরসালা-তে এই বিষয়টা বলেছিলেন | একজন আন্দুলুসিয়ান সুফি সাধক ইবন সবিন তার লেখায় এই কথাটা ব্যবহার করেছিলেন | কিন্তু যে সুফি সাধক সবচেয়ে গভীরভাবে এই তত্ব আলোচনা করেছেন তিনি হলেন আর কেউ নন , ইবন আরবী | তিনিই ওজুদ শব্দটিকে আল্লা অর্থে ব্যবহার করেছেন |তিনি বলতে চেয়েছেন যে ওজুদ বা সত্তা শুধু আল্লার আছে | তিনি আরো একটা টার্ম ব্যবহার করেছিলেন: “আল্লা ছাড়া আর সব বস্তু” | তিনি বলেছিলেন যে জগতের বস্তুসকল আল্লা থেকে ওজুদ বা সত্তা ধার করেছে যেভাবে পৃথিবী সূর্যের আলো ধার করে | তিনি তার তানজিহ তে আরো বলেন যে জগতের বস্তুসকলের কোনো অস্তিত্ব নেই আল্লা ছাড়া | তসবির দিক থেকে তিনি বলেন যে সমস্ত বস্তু সত্তা বা ওজুদের প্রকাশ ছাড়া কিছু নয় |
ইবন আরাবী বলেছেন যে ওজুদ বা সত্তাই হলো একমাত্র বাস্তব যা থেকে বাকি বাস্তবগুলি এসেছে | বাহ্য দুনিয়া হলো আল্লার এক ছায়ামাত্র | আল্লা একাই হলো সর্বব্যাপী চিরন্তন এক সত্য | যা কিছু বাহ্য বস্তু সবই আল্লার ছায়া বা তাজাল্লি মাত্র , আল্লা থেকে পৃথক নয় | ইবন আরাবির নিজের ভাষায় এই তত্বের সারাংশ হলো : “সেই আল্লার জয় হোক যে সবকিছুর মূল হয়ে সবকিছু সৃষ্টি করেছে |” ওজুদ বা সত্তাকে এক বলার অর্থই হলো সমস্ত জীবেরএকতা ঘোষনা | সত্তা অসীম (মুতলাক) ও অখন্ড | আর সত্তা ব্যতীত যাহাই আছে তা বিভিন্ন এবং সীমিত (মুকায়্য়াদ) |রহস্যবাদী চিন্তাবিদ এবং ধর্মতত্ত্ববিদ আবু সাঈদ মোবারক মাখজুমী তার তোহফা মুরসালা নামক গ্রন্থে এই ধারণাটি নিয়ে আলোচনা করেছেন। আন্দালুসীয় সুফি সাধক ইবনে সাবিন তার লেখায় এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন বলেও জানা যায়। তবে যে সূফী সাধক গভীর ও বিশদভাবে সূফী অধিবিদ্যার এ আদর্শের আলোচনায় সর্বাধিক বৈশিষ্ট্যযুক্ত, তিনি হলেন ইবনে আরাবী। তিনি ঈশ্বরকে প্রয়োজনীয় সত্তা হিসাবে উল্লেখ করার জন্য ওজুদ শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি এই শব্দটিকে ঈশ্বর ব্যতীত অন্য যে কোনও কিছুর সাথেও দায়ী করেছেন, কিন্তু তিনি জোর দিয়েছিলেন যে ওজুদ কোন সত্য অর্থে বিশ্বজগতে প্রাপ্ত জিনিসের অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং পৃথিবী যেমন সূর্য থেকে আলো গ্রহণ করে, ঈশ্বরের কাছ থেকে তেমনি সব জিনিড উজুদকে ধার করে। বিষয়টি হল ওজুদের উপাধি কীভাবে কোন জিনিসে সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হয়, তাকে "সত্তা" (আয়ান) বলা হয়। তানজির দৃষ্টিকোণ থেকে ইবনে আরবী ঘোষণা করেছেন যে ওজুদ একমাত্র ঈশ্বরের অন্তর্ভুক্ত, এবং তার বিখ্যাত উক্তিতে এই কোন "কখনোই ওজুদের গন্ধের ছিটেফোটা পায় নি।"
ওয়াহদাত আল-উজুদ যার আক্ষরিক অর্থ "অস্তিত্বের ঐক্য" বা "সত্তার ঐক্য।" উজুদ বা "অস্তিত্ব, উপস্থিতি" বলতে এখানে ঈশ্বরকে বোঝায়।
Comments
Post a Comment